চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ অনলাইন পরীক্ষা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

দুপুর ২টা বাজতে ২০ মিনিট বাকি। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। তিনজন শিক্ষক ও কয়েকজন কর্মকর্তার অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়টি তদারকি করছেন উপাচার্য নিজেই।

বৃহস্পতিবারের (২৪ জুন) এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন গাণিতিক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রথম সেমিস্টারের দ্বিতীয় কোর্সের পরীক্ষা আজকে। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই উপস্থিত ওই বর্ষের ৯৪ জন শিক্ষার্থীর সবাই। এ সময় শিক্ষকরা গুগল ক্লাস রুমে পিডিএফ ফাইলের একটি প্রশ্ন আপলোড করেন। ১০ মিনিটের মধ্যে হাতে পাওয়া প্রশ্ন লিখে নিয়ে দুপুর ২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্রে লেখা শুরু করেন। জুম অ্যাপের সহযোগিতায় কয়েকটি ল্যাপটপের সমন্বয়ে তাদের পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি তদারকি করছেন শিক্ষকরা।

সিভাসু কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের বিভিন্ন বর্ষে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত ১৫ জুন থেকে। সেদিন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একটি কোর্সের অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়। এতে অংশ নিয়েছিলেন ওই বর্ষের ৫৭ জন শিক্ষার্থীর সবাই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ৫০টি পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আরও ১৬৩টি পরীক্ষা হবে। শুরুতে কিছুটা জটিলতা দেখা দিলেও ধীরে ধীরে এ পদ্ধতিতে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী অনেকটা স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। একই বছরের জুনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধীরে ধীরে অনলাইন ক্লাস চালু হয়। কিন্তু স্মার্টফোন ও নেটওয়ার্কসহ নানা জটিলতায় আলোর মুখ দেখেনি অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম। পরীক্ষা তো দূরের কথা, ক্লাস নিয়ে জটিলতায় থমকে আছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

অন্যদিকে বন্ধের পরপরই দেশের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের কার্যক্রম শুরু হয়। এতে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষাবর্ষ সম্পন্ন করতে পারছেন তারা। কিন্তু বিপাকে পড়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস কিছু হলে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া যেন কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। দিন যত গড়িয়েছে ততই পিছিয়ে পড়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

যদিও সম্প্রতি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সশরীরে পরীক্ষা নিতে নির্দেশনা দেয় ইউজিসি কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। গত ২১ জুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এক ব্রিফিংয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাত জেলা মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও গোপালগঞ্জে লকডাউন ঘোষণা করেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় সিভাসুর অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন পথ দেখাবে বলে আশা প্রকাশ করছেন অনেকে।

এদিকে সিভাসু কর্তৃপক্ষ জানায়, ইউজিসির নির্দেশনা পেয়ে গত বছরের জুন থেকে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেন তারা। এরপর একটি সেমিস্টার শেষে পরের সেমিস্টারের ক্লাস অনলাইনে সম্পন্ন হয়। কিন্তু কোনোভাবেই পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয় নিয়ে গত মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করেন উপাচার্য। সিদ্ধান্ত হয় অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়ার। শুরুতে অনেক শিক্ষক রাজি না হলেও পরবর্তীতে উপাচার্যের আশ্বাসে রাজি হন তারা।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের একাধিকবার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া শিক্ষকদের ১৮ দিন ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক পর্যায়ে দেশের প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সিভাসুতে গত ১৫ জুন থেকে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম।

পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে সিভাসুর আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গুগল ক্লাস ও জুম অ্যাপের সহযোগিতায় তাদের এ পরীক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের ১০ মিনিট আগে গুগল ক্লাসে প্রশ্ন আপলোড করা হয়। আপলোড করা প্রশ্ন ১০ মিনিটেই লিখে নেন শিক্ষার্থীরা। এরপর নির্ধারিত সময়ে শুরু হয় পরীক্ষা। ইউজিসি প্রদত্ত জুম অ্যাপের বিশেষ লিংক ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের তদারকি করেন কয়েকজন শিক্ষক। নির্ধারিত সময়ের পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা আবার উত্তরপত্র স্ক্যান করে গুগল ক্লাস রুমে আপলোড করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব উত্তরপত্র প্রিন্ট করে মূল্যায়ন করেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের মূল উত্তরপত্রও সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার নাসিম আহমেদ  বলেন, ইউজিসি প্রদত্ত জুম অ্যাপের বিশেষ প্ল্যাটফর্ম ‘বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডুকেশন নেটওয়ার্ক (বিডিআরইএন)’ ব্যবহার করে সিভাসুর ক্লাস নেয়া এবং পরীক্ষা গ্রহণের সময় শিক্ষার্থীদের তদারকি করা হয়। এছাড়া পরীক্ষার ক্ষেত্রে গুগল ক্লাসরুম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন প্রদান ও উত্তরপত্র গ্রহণ করা হয়।

এ বিষয়ে সিভাসু উপাচার্য ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, ‘গত বছরের জুনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছিল। এক সেমিস্টারের পর অন্য সেমিস্টারের ক্লাস সম্পন্ন হলেও কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া যাচ্ছিল না। গত ডিসেম্বরে আমরা কয়েকটা পরীক্ষা অনলাইনে নিয়ে কিছু শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু এরপর দেশে হল খোলার আন্দোলন হলে সরকার আবারও সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করেন। এদিকে করোনা পরিস্থিতিও দিন থেকে দিন খারাপ হতে থাকে। এ অবস্থায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা করে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আমাদের সশরীরে পরীক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যেহেতু হলে থাকতে পারবে না, আবার শহরের বিভিন্ন জায়গায় থেকে পরীক্ষায় গ্রহণ করাটা তাদের জন্য আর্থিকভাবে কষ্টকর হবে, তাই অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগ থেকে আমি নিজেসহ সব শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করা হয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আমরাই প্রথম অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করছি। আমার মেয়ে বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় পরীক্ষা দিতে পারলে আমার ছাত্ররা কেন পারবে না—এই চিন্তা থেকে অনলাইন পরীক্ষা চালু করেছি।’

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্ক নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে কোনো সমস্যা হয়নি। শতভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। আমি মনে করি, বর্তমানে সরকার যে ইন্টারনেট সুবিধা দিচ্ছে, অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষার জন্য সেটা যথেষ্ট। তাছাড়া দেশের সব জায়গায় কোনো না কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্ক ভালো থাকে। কিছু শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন সমস্যা ছিল। আমাদের কাছে ৪৫ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। আমরা সবাইকে ১০ হাজার টাকা করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঋণ দিয়েছি। যদিও ইউজিসি থেকে আমরা স্মার্টফোনের জন্য কোনো বরাদ্দ পায়নি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ  বলেন, ‘আমরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন এবং সশরীরে দুইভাবেই পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির আলোকে কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করবেন সেটার সিদ্ধান্ত নেবে। যেমন দেশের রাজশাহী অঞ্চলে এখন করোনা পরিস্থিতি খুব খারাপ। ঢাকার অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এসব জায়গায় সশরীরে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সিভাসুর অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি প্রশংসনীয়। যদি অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই সন্তুষ্ট থাকে, তবে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো। এর মাধ্যমে পরিস্থিতি খারাপ হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর পিছিয়ে থাকবে না।’