প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদার স্বপদে বহাল রয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সহকর্মীদের হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এদিকে অধ্যক্ষের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালিপনার প্রতিবাদে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা শনিবার থেকে কলেজে অবস্থান ধর্মঘট ও কালোব্যাজ ধারন কর্মসূচী পালন শুরু করেছে।
কলেজ ক্যাম্পাসে শনিবার সকাল দশটা থেকে শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ কর্মসূচী শুরু করে। এ প্রসঙ্গে অবস্থান ধর্মঘটে যাওয়া শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেন, ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি যোগদানের পর থেকে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অভিযোগের তদন্ত করে। গত ২২ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় অধ্যক্ষ সাহিদুরকে প্রত্যাহার করে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে ন্যস্ত করে। গত ২৯ এপ্রিল সামরিক সচিবের পক্ষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু হায়াত স্বাক্ষরিত অপর একটি পত্রে তাকে বিএমএতে পদায়ন করা হয়। কিন্তু তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে সহকর্মী শিক্ষকদের হয়রানি করে আসছেন। এ ঘটনায় কলেজের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেছেন।
একই সঙ্গে তারা এ কর্মসূচী পালন শুরু করেছে। অধ্যক্ষ সিনিয়রদের কারো কাছে দ্বায়িত্ব হস্তান্তর না করলে আরো কঠোর কর্মসূচী দেয়া হবে বলে জানান তারা।
এ ব্যাপারে কলেজ শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ জানান,
অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারকে কলেজ থেকে প্রত্যাহার করা হলেও তিনি এখনো কলেজে অবস্থান করছেন যা দুঃখজনক। তিনি কোনো একজন সিনিয়রদের কাছে দ্বায়িত্ব দিলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় প্রত্যাহার করে নিলেও তিনি কলেজে বসে শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের হয়রানী করছেন এবং কলেজের বিভিন্ন নথিপত্র পরিবর্তন পরিমার্জন করছেন যা বেআইনি ও অবৈধ। তিনি শিক্ষক ,কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কে পত্র দিয়ে টাকা ফেরৎ দানের আদেশ দিয়েছেন যা শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশের লঙ্গন।
মাসুম বিল্লাহ বলেন,অধ্যক্ষের বদলির আদেশ হয়ে গেছে। তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর না করলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক শাখার শিক্ষক মোঃ শাহজাহান বলেন,বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অধ্যক্ষের অনিয়ম, হয়রানী এবং অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান ধর্মঘট ও কালো ব্যাজধারন কর্মসূচী শুরু করেছে। অধ্যক্ষ দ্বায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত এ কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে।
এ ব্যাপারে সাহিদুর রহমান মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, কলেজে উপাধ্যক্ষ নেই, সরকারি শিক্ষা ক্যাডারও নেই। কার কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করব? এ বিষয়টি জানিয়ে ডিজি ও শিক্ষা সচিবকে চিঠি দিয়েছি। এছাড়া তারা যে অভিযোগ করছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
উল্লেখ্য,বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালিপনা, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা, পর্ষদের সভাপতির আদেশ অমান্য করা, ফান্ডে অর্থ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করে দেয়া, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে বেতনের অতিরিক্ত বিশ ভাগ টাকা নেয়া, কর্মচারিদের অতিরিক্ত কর্মের টাকা না দেয়া, লাগাতার প্রায় আড়াই মাস কর্মস্থলে না থাকার বিষয়গুলো উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সচিবের নিকট অভিযোগ দেয় নাজমুল হক নামে একজন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। অভিযোগে উল্লেখ করা হয় কর্মস্থলে না থেকে গাড়ির তেল, ভুয়া বিল ভাউচার এর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে। সকল অভিযোগের তদন্ত শেষে তদন্ত কমিটি অভিযোগের সকল বিষয়বস্তুর প্রমান পেয়ে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় অধ্যক্ষকে প্রত্যাহার করে নেয়।
অধ্যক্ষ’র বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রমান পেয়ে ভুয়া বিল ভাউচার ফেরৎ পাঠিয়েছেন পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার মোঃ ইয়ামিন চৌধুরী। তার বদলির পর বিভাগীয় কমিশনার অমিতাভ সরকার সভাপতির দায়িত্ব নেন। তিনিও অধ্যক্ষকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে দুটি শোকজ করেছেন। শিক্ষক ও কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করে দেয়ার পরে তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় বেতনের অতিরিক্ত বিশ ভাগ টাকা আটকে দিয়েছিলেন সভাপতি।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক-২ শাখা থেকে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এর অধ্যক্ষের অতিরিক্ত ভাতা সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের মুল বেতনের শতকরা ২০ ভাগ বিশেষ ভাতা (অতিরিক্ত ভাতা) প্রদানের সুযোগ নেই। এরপরও বর্তমান অধ্যক্ষ যোগদানের পর থেকেই পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি ছাড়া ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ অমান্য করে বেতনের অতিরিক্ত শতকরা বিশ ভাগ বেতন নিয়েছেন, যা সম্পূর্ন অবৈধ। সূত্রে আরো জানা যায়, গত বছর ১১ জুন বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ৪০ জন স্থায়ী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে বেতন অব্যাহত রাখার একটি আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করেন অধ্যক্ষ যোগদানের তারিখ থেকে শতকরা বিশ ভাগ পেনশন ভাতা গ্রহন করে আসছেন যা মন্ত্রনালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার অধ্যক্ষের মে’ ২০ ও জুন’ ২০ এর বেতন আটকে দিয়ে বেতনের অতিরিক্ত শতকরা বিশ ভাগ বাদ দিয়ে বেতন দাখিল করার নির্দেশ প্রদান করেন। এদিকে অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদার ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২ জুন পর্যন্ত করোনা মহামারির কারনে বরিশালে না থেকে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। অথচ এপ্রিল ও মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি ব্যবহারের জ্বালানী ও মেরামতের ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করেন। তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার মোঃ ইয়ামিন চৌধুরী গাড়ি সংক্রান্ত ভুয়া বিল আটকে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গাড়ির ড্রাইভার মোঃ শাহিন বলেন, ওই সময় করোনার কারনে গাড়ি গ্যারেজে ছিল। আমি গাড়ি ড্রাইভ করি নাই। অধ্যক্ষ স্যার বলেছেন বিল ভাউচার করে দিতে তাই বিল ভাউচার করে দিয়েছি। এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর ২৩৪৯ নং স্মারকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের লক্ষ্যে নিয়োগ, পদোন্নতি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর ও অর্থ ব্যয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রসঙ্গের শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
বিজ্ঞপ্তিতে ১২ টি মডেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর (প্রাতিষ্ঠানিক দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনের ব্যয় ব্যতিত) এবং নগদ ও ব্যাংকে সংরক্ষিত অর্থ ব্যয়ের উপর নির্দেশক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তাই নয়, অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদার যোগদানের পরেই সিসিটিভি ক্যামেরা ক্রয়, ভবন মেরামত, অধ্যক্ষের বাস ভবন মেরামত, টেবিল চেয়ার মেরামত, ভবনের ছাঁদ মেরামত, পানির লাইন স্থাপনসহ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন শিক্ষা অধিদপ্তের আদেশ নিষেধ অমান্য করে। পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের নামে তিনি এসব আর্থিক কর্মকান্ড করেছেন। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিধি না মেনে নিজেই কেনা কাটা করেছেন অর্থ আত্মসাতের জন্য। বর্তমানে অধ্যক্ষের চতুরতা ও খামখেয়ালীপনা, দুর্নীতি আর অনিয়মের কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে।
এছাড়া তিনি দুর্নীতি অনিয়ম ঢাকতে বিবিন্ন কৌশল নিচ্ছেন। এদিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ক্লাশের নামে আদায়কৃত অর্থ থেকে শতকরা ১৫ ভাগ অর্থ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা ‘১২ এর বিরোধী। নীতিমালার ২ এর (গ) তে উল্লেখ রয়েছে প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং সহায়ক কর্মচারীদের ব্যয় বাবদ ১০ শতাংশ অর্থ রেখে অবশিষ্ট অর্থ অতিরিক্ত ক্লাসের সাথে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এক্ষেত্রে অধ্যক্ষের নামে কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও অধ্যক্ষ অবৈধভাবে আদায়কৃত অর্থের শতকরা ১৫ ভাগ শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ তিনি একজন স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের মানুষ। তিনি একা একাই সব করেন। কারো আদেশ নিষেধ মানেন না। তিনি বলেন, আমরা হুকুমের গোলাম।