মুখের রুচি বাড়াতে ভিটামিন ‘সি’-তে ভরপুর আমলকির জুড়ি নেই। লিভার, জন্ডিস, পেটের পীড়া, সর্দি, কাশি ও রক্তশূন্যতায় এ ফল বেশ উপকারী। এছাড়া চুলের গোড়া শক্ত হওয়া, চুল পড়া এবং অল্প বয়সে চুল পাকা বন্ধ করতেও আমলকি ব্যবহার হয়।
নানা গুণে ভরপুর হওয়ায় আমলকির কদর সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে রয়েছে। ফলে এর প্রতি এক ধরনের বাড়তি চাহিদা রয়েছে নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই। আর মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে সেই চাহিদা যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। ফলে কোথাও কোথাও আমলকির কেজি ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, আমলকিতে পেয়ারার চেয়ে ১০ গুণ ও কাগজি লেবুর চেয়ে ৩ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এছাড়া আমলকিতে কমলার চেয়ে ১৫-২০ গুণ, আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ, আমের চেয়ে ২৪ গুণ এবং কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। একজন বয়স্ক লোকের প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ দরকার। এ পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ দিনে দুটি আমলকি খেলেই এসে যায়।
এদিকে মহামারি করোনার প্রেক্ষিতে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভিটামিন সি ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দৃঢ় করে। এছাড়া ত্বকে যে অক্সিড্যান্ট স্ক্যাভেনজিং প্রক্রিয়া আছে, তাকেও সাহায্য করে ভিটামিন সি। ফলে সম্ভাব্য জারণ প্রক্রিয়ার চাপ থেকে কোষ কিংবা টিস্যু রক্ষা পায়।
ভিটামিন সি ফাগোসাইটিক কোষগুলিতে জমে থাকা নিউট্রোফিলস এবং কেমোট্যাক্সিস, ফাগোসাইটোসিস, প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতির উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। এমনকি অণুজীবের ধ্বংস হারও বাড়িয়ে দেয়। ম্যাক্রোফেজ দ্বারা সংক্রমণের স্থান থেকে অ্যাপোপটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত কোষ এবং ব্যবহৃত নিউট্রোফিলগুলিকে সরিয়ে ফেলে। ফলে নেক্রোসিস এবং সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর পরিমাণ কমে যায়।
সম্প্রতি আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন জার্নাল -এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এআরডিএস-এ আক্রান্ত ১৬৭ জন রোগীর ওপর করা এক গবেষণার বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেই প্রবন্ধে। ওই গবেষণায় রেগীদের দিনপ্রতি ১৫ গ্রাম ইন্ট্রাভেনাস (আইভ) ভিটামিন সি দেয়া হয়েছে পর পর চারদিন। ফলে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
করোনা আক্রান্ত চীনের ৫০ রোগীর ওপর করা আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই গবেষণায় দেখা গেছে, একটি উচ্চমাত্রা (ডোজ) আইভি ভিটামিন সি সফলভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে অক্সিজেনেশনের হার। সব রোগী শেষ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছে।
কোরিয়ান আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে ১৪৪৪ জনকে নিয়ে করা হয়েছে আরেকটি গবেষণা। তাতেও দেখা গেছে, ওরাল ভিটামিন সি (৬ গ্রাম/প্রতিদিন) ভাইরাল সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে সক্ষম। এ গবেষণার রিপোর্ট গত মার্চে বিএমজে মিলিটারি হেলথ জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়।
ভিটামিন সি এর এসব গুণের কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলের চাহিদা বেড়েছে। এর মধ্যে আমলকি উল্লেখযোগ্য। একদিকে চাহিদা বাড়া অন্যদিকে সরবরাহ কম থাকায় হুঁ হুঁ করে বেড়েছে আমলকির দাম।
রোববার (২৮ জুন) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাজার ও সুপারশপে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি কেজি আমলকি বিক্রি হচ্ছে ৮৫০-১০০০ টাকায়। খুচরায় ৫০ গ্রাম আমলকি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা।
খিলগাঁও তালতলায় ৫০ গ্রাম আমলকি ৬০ টাকা বিক্রি করা আশরাফুল বলেন, এখন বাজারে আমলকির বেশ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বাজারে সেইভাবে সরবরাহ নেই। ৫০ গ্রাম ৬০ টাকা হওয়ার পরও প্রতিদিন যা নিয়ে আসি তা দেখতে দেখতে বিক্রি হয়ে যায়।
খিলগাঁওয়ে সিপাহীবাগ বাজারে ৫০ গ্রাম আমলকি ৫০ টাকা বিক্রি করা মজনু বলেন, পাইকারিতে আমলকির দাম খুব বেড়েছে। আগে আমরা একশ গ্রাম আমলকি ১০-২০ টাকা বিক্রি করেছি। কিন্তু এখন যে দামে কেনা পড়ছে তাতে ৫০ গ্রাম ৫০ টাকার নিচে বিক্রি করার সুযোগ নেই।
রামপুরার ব্যবসায়ী আমিনুর বলেন, করোনার কারণে কয়েক মাস ধরে আমলকির চাহিদা অনেক বেড়েছে। আগে বেশিরভাগ মানুষ ৫০ গ্রাম ১০০ গ্রাম করে আমলকি কিনতো। এখন অনেকে ২৫০ গ্রাম, অধাকেজি করে কিনছে। বাজারে আমলকির যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে সরবরাহ তার তুলনায় কম। ঈদের আগেও একশ গ্রাম আমলকি ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করেছি। এখন বিক্রি করছি ১০০ টাকায়।
বিভিন্ন এলাকার বাজারের পাশাপাশি সুপাশপেও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে আমলকি। স্বপ্নের বনশ্রী শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিকেজি আমলকি ৮৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। একই দামে আমলকি বিক্রি হচ্ছে স্বপ্নের খিলগাঁও শাখায়।
স্বপ্নের বনশ্রী শাখার কাওছার হাসান বলেন, আমরা এখন প্রতিকেজি আমলকি ৮৫০ টাকা বিক্রি করেছি।
আগে তো আমলকির কেজি ৩০০ টাকা ছিল। এখন দাম এতো বাড়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩০০ টাকা আরও দুই মাস আগে ছিল। এখন এটা অ্যাভেলেবল না। সে কারণেই হয়তো প্রাইসটা একটু বেশি।
স্বপ্নের খিলগাঁও শাখায় যোগাযোগ করা হলে ছারা বলেন, আমরা আমলকির কেজি ৮৫০ টাকা বিক্রি করেছি। এ সময় দামটা একটু বেশি হয়ে গেলো না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্যার আমি তো দাম নির্ধারণ করি না।’
এদিকে আমলকি নিয়ে উইকিপিডিয়ার তথ্য বলা হয়েছে, প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি (আমলকি) ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে পারে। প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, রিউমেটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং অস্টিওপোরোসিস রোগে আমলকির রস কিছু কাজ করে। কয়েক ধরনের ক্যান্সারের বিরুদ্ধেও এর কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগেও আমলকি কার্যকর বলে ইঁদুরের উপর চালিত গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে। প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগের পরে ক্ষতিগ্রস্ত প্যানক্রিয়াস (অগ্ন্যাশয়) -এর ক্ষত সারাতে আমলকি কার্যকর।
আমলকির ভেষজ গুণ রয়েছে অনেক। ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে ব্যবহার করা হয়। আমলকিতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। আমলকি খেলে মুখে রুচি বাড়ে। স্কার্ভি বা দন্তরোগ সারাতে টাটকা আমলকি ফলের জুড়ি নেই। এছাড়া পেটের পীড়া, সর্দি, কাশি ও রক্তহীনতার জন্যও খুবই উপকারী। লিভার ও জন্ডিস রোগে উপকারী বলে আমলকি ফলটি বিবেচিত। আমলকি, হরিতকি ও বহেড়াকে একত্রে ত্রিফলা বলা হয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ত্রিফলা স্বাস্থ্যের জন্য বহুমাত্রিক উপকারী। এ তিনটি শুকনো ফল একত্রে রাতে ভিজিয়ে রেখে সকালবেলা ছেঁকে খালি পেটে শরবত হিসেবে খেলে পেটের অসুখ ভালো হয়- বলেও উইকিপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।