রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বড় সংকটের মুখে জার্মানি। মাত্র আড়াই মাস চলার মতো গ্যাসের মজুত রয়েছে তাদের হাতে। ফলে নতুন সরবরাহ না পেলে খুব শিগগির বড় বিপদে পড়তে চলেছে জার্মানরা। দেশটিতে গ্যাসের দাম দুই-তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। এমনকি প্রয়োজনে গ্যাস রেশনিংয়ের পথে হাঁটতে হতে পারে জার্মান সরকারকে।
ইউক্রেন আক্রমণের জেরে রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি সীমিত করাসহ একঝাঁক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জবাবে, ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে মস্কো।
জার্মান অর্থ মন্ত্রী রবার্ট হাবেক বলেছেন, ইইউর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার জবাব দিতে গ্যাসকে ‘অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করছে রাশিয়া। তিনি বলেন, আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো মানে হয় না। গ্যাস সরবরাহ কেটে দেওয়া পরিষ্কার আমাদের ওপর [রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির] পুতিনের হামলা। জার্মানিকে এখন গ্যাসের ব্যবহার কমাতে হবে।
হাবেক বলেন, তিনি আশা করছেন, জার্মানিতে কখনোই শিল্পখাতে গ্যাস রেশনিংয়ের প্রয়োজন পড়বে না। তবে সেই সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করেও দেওয়া যাচ্ছে না।
আপৎকালীন পরিকল্পনা
জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হলে বা চাহিদা খুব বেড়ে গেলে তা মোকাবিলায় তিন স্তরের একটি আপৎকালীন পরিকল্পনা রয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) থেকে সেই পরিকল্পনার দ্বিতীয় স্তর কার্যকর করেছে দেশটি।
এখন গ্যাস মজুতকরণ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস ভর্তি করার জন্য জার্মান সরকার ১ হাজার ৫০০ কোটি ইউরো ঋণ দেবে। শিল্পখাতে গ্যাস নিলামে বিক্রি শুরু হবে, যেন যাতে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কম গ্যাস ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়। এছাড়া গ্যাস কিনতে যে বাড়তি দাম লাগছে, তা ক্রেতাদের ওপর চাপানোর অনুমোদন দিয়েছে জার্মান সরকার।
ফেডারেল নেটওয়ার্ক এজেন্সির প্রধান মুলার বলেছেন, জার্মানির কাছে গ্যাসের পুরো সঞ্চয় থাকলে রাশিয়ার ওপর এখন নির্ভর করতে হতো না। তাদের হাতে মাত্র আড়াই মাস চলার মতো গ্যাস মজুত রয়েছে। তারপরই সব ট্যাংক খালি হয়ে যাবে। তার মতে, জার্মানিকে বড় সংকট থেকে বাঁচাতে হলে অন্য জায়গা থেকে গ্যাস আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে।
অন্য একটি সাক্ষাৎকারে মুলার বলেছেন, গ্যাসের দাম তিনগুণ বাড়তে পারে। তিনি বলেন, জার্মানিকে এই পরিকল্পনার তৃতীয় স্তর কার্যকর করতে হলে পরিণতি হবে ভয়ংকর। তখন গ্যাস রেশনিং করতে হবে, প্রয়োজনভিত্তিক অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সরবরাহ কমিয়েছে রাশিয়া
ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জার্মানিসহ ইইউর দেশগুলো রুশ তেল আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। তবে বার্লিন এখনো রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করেনি।
এ অবস্থায় গত সপ্তাহে যন্ত্রপাতির সমস্যা হচ্ছে দাবি করে নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয় রাশিয়া, যার প্রভাব পড়েছে জার্মানিতে।
জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন দিয়ে এখন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক কম গ্যাস আসছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী শীতে প্রয়োজনীয় মজুতের ৯০ শতাংশ নিশ্চিত করতে জার্মানিকে বেগ পেতে হবে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা গ্যাজপ্রম জানিয়েছে, নর্ড স্ট্রিমের মাধ্যমে তারা জার্মানিকে যে গ্যাস দেয়, তার সরবরাহ আরও কমিয়ে দেওয়া হবে। তারা ফ্রান্স, ইতালিকেও কম গ্যাস দিচ্ছে।
ঝুঁকিতে ইউরোপ
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় সমস্যায় পড়েছে ইউরোপের অন্তত ১২টি দেশে। গত বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন ইইউ’র পরিবেশনীতি বিষয়ক প্রধান ফ্র্যান্স টিমারম্যান্স।
গ্যাস কেনার অর্থ রুশ মুদ্রা রুবলে পরিশোধের নীতি প্রত্যাখান করায় এরই মধ্যে পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক এবং ফিনল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া।
তেল ও গ্যাস বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইনভেসটেকের প্রধান নাথান পাইপারের মতে, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া ততটা উদ্বেগের নয়। কিন্তু শীতের সময় পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেসময় ঘরবাড়ি গরম রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, জার্মানিকে আপৎকালীন ব্যবস্থার তৃতীয় স্তর কার্যকর করতে হয় কি না সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু শীত মৌসুমে গ্যাসের দাম বেড়ে গেলে শিল্পখাতগুলো চাহিদা কমাতে বা নিজেরাই রেশন ব্যবস্থা চালু করতে চাইবে, এমন আশঙ্কা অনেক বেশি। কারণ মজুত গ্যাস ছেড়ে দেওয়া তখন অর্থকরী হবে না।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে, বিবিসি বাংলা