কালো চশমার নিচে চোখ দুটি ঢাকা। একজন হাত ধরে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। চশমাটা সরিয়ে নিতেই দেখা গেল বীভৎস দুটি চোখ। চোখের দিকে তাকানোই যায় না।
এ অবস্থা জীবনযুদ্ধে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আসা এক গৃহবধূর। নাম রাজিয়া খাতুন (২৮)। তিনি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কাশিপুর গ্রামের মনির উদ্দীন দফাদারের মেয়ে।
অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল রাজিয়ার। তাই বলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেননি। স্বামীর সংসার সামলেও স্নাতকোত্তর শেষ করে ছেড়েছেন। আরেকটু এগোতে পারলেই হয়তো সরকারি কোনো বড় পদে দেখা যেত রাজিয়াকে। এই নারীর সেই পথে কাঁটা দিয়েছেন আর কেউ নন, স্বয়ং তাঁর স্বামী কামরুজ্জামান। অ্যাসিড দিয়ে রাজিয়ার দুটি চোখই নষ্ট করে দিয়েছেন। কামরুজ্জামান মনিরামপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুর গ্রামের মৃত আবদুস সামাদ মোড়লের ছেলে। তিনি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। ঘটনার পর থেকে পলাতক।
সম্প্রতি রাজিয়া খাতুন স্বজনদের সহায়তায় এসেছিলেন যশোর আঞ্চলিক কার্যালয়ে। শোনালেন জীবনের নানা চড়াই-উতরাইয়ের কাহিনি।
রাজিয়া বললেন, ‘বছর দশেক আগে আমাদের বিয়ে হয়। তখন আমি সবে এসএসসি পাস করেছি। স্বামী তেমন লেখাপড়া জানেন না। এর মধ্যে আমাদের একটি ছেলেসন্তান হয়। এরপর অনেক কষ্টে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এম এম) কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করি।’
নিজের চেষ্টায় যখন এত দূর এসেছেন, ভালো একটা চাকরি পাবেন সেই আশা ছিল রাজিয়ার মনেপ্রাণে। বিসিএস পরীক্ষার জন্য কোচিং করতে স্বামী-সন্তান নিয়ে চলে যান ঢাকায়। কিন্তু একমাত্র সমস্যা টাকা। টিউশনি করে কিছু উপার্জন করা শুরু করেন রাজিয়া। কিন্তু সেই টাকায় কি স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকার খরচ মেটে? বাধ্য হয়ে স্বামী-সন্তানকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
রাজিয়া বললেন, ‘আমি ঢাকাতেই থাকতাম। ২১ জানুয়ারি বাবার বাড়িতে যাই। তখন লেখাপড়া ও চাকরি নিয়ে কামরুজ্জামানের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। ২৪ জানুয়ারি ভোরে আমার দুই চোখে কয়েক ফোঁটা ওষুধ দিই। মুহূর্তের মধ্যে চোখ ঝলসে যায়। আমার চিৎকার শুনে বাড়ির অন্যরা এগিয়ে আসেন। এ সময় আমার স্বামী দৌড়ে পালিয়ে যান।’
ওষুধের ওই পাত্রে (ড্রপ) আসলে অ্যাসিড ছিল। সেটা যে রাজিয়ার স্বামী কামরুজ্জামানের কাজ, তখনই বুঝে যান সবাই। রাজিয়া প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। চোখের আলো নিভে গেছে রাজিয়ার।
রাজিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেকে নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর দিন কাটাচ্ছি। এখন চিকিৎসা করার টাকা পর্যন্ত নেই। নয় বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে অন্ধকারে পথ হাঁটতে হচ্ছে আমার।’
এদিকে এ ঘটনায় রাজিয়া খাতুনের ভাই আবু তাহের মনিরামপুর থানায় অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে একটি মামলা করেন। মামলায় একমাত্র আসামি রাজিয়ার স্বামী কামরুজ্জামান। ঘটনার তিন মাস পরও তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোকাররম হোসেন বলেন, কামরুজ্জামান তাঁর বন্ধুদের প্ররোচনায় স্ত্রীকে চাকরি করতে দিতে চাইতেন না। বড় চাকরি পেলে রাজিয়া স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারেন, এই শঙ্কা জাগে তাঁর মনে। ওই শঙ্কা থেকেই কামরুজ্জামান স্ত্রীর চোখের ড্রপের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে অ্যাসিড রাখতে পারেন বলে পুলিশ ধারণা করছে। তিনি বলেন, ঘটনার পর থেকেই কামরুজ্জামান পলাতক। তবে তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।