মেহেরপুরের ভাষা সৈনিক ইসমাইল হোসেন মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বৃহস্পতিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১১ টার দিকে মেহেরপুর ২৫০ শষ্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মরহুমের জামাতা অ্যাড. মোখলেছুর রহমান স্বপন জানান, তিনি দীর্ঘদিন যাবত লিভার ও কিডনি সমস্যাসহ নানা রোগে ভুগছিলেন। আজ শুক্রবার বাদ জুমা মেহেরপুর হোটেল বাজার জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে তার নামাজে জানাজা শেষে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
ফিরে দেখা:
মেহেরপুর শহরের হোটেল বাজার শহীদ গফুর সড়কের বাসিন্দা এস্কেন্দার জুলকার নাইন ও খালেছা খাতুনের ১১ সন্তানের মধ্যে বড় মহাঃ ইসমাইল হোসেন। তিনি ১৯৫১ সালে মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ১৯৫১ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনিসহ অন্যরা ভাষার জন্য লড়াই করে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। অবশেষে তিনিসহ ওই স্কুলের ৭ জন ছাত্র পান রাশ টিকিট। যে কারণে ইসমাইল হোসেন দারিয়াপুর হাই স্কুলে ভর্তি হন। তারপর তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং স্নাতক পাশ করেন। অন্যান্যদের মতো ইসমাইল হোসেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ভাষা সৈনিকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চেয়েছিলেন।
বয়সের সীমাবদ্ধতা না থাকায় ১৬ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে ইসমাইল হোসেন মেহেরপুর মডেল হাই স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তদানিন্তন পাক-সরকারের চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ঢাকার ৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। এতে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদ হন।
এ বিষয়ে ইসমাইল হোসেন বলেছিলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি খবরটা মেহেরপুর পৌঁছালে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা মিছিল বের করি। এরপর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস পালনের জন্য মিছিল মিটিং ও পোস্টারিং করি। পুলিশ এতে বাধা দেয় এবং লাঠি চার্জ করে মিছিল মিটিং ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একই অপরাধে নেতৃত্বদানকারী আমিসহ আমাদের ৭ জনকে পুলিশ আটক করে থানায় নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনি লড়াইয়ের পর আমরা ৭ জন ছাত্র মুক্তি পাই। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল আমাদের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) সাবদার আলী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। যে কারণে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে তিনি আমাদের ৭ জনকে রাশ টিকিট দিয়ে বহিস্কার করেন।
এরপরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের গুরু সাজা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তখন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক (একজন নন ব্যাঙ্গুলি) মেহেরপুর মহাকুমাতে আসেন। তার আসার সংবাদে আমাদের অভিভাবকরা রাস্তা ব্যারিকেড করতে রাস্তার উপর শুইয়ে পড়েন। তিনি গাড়ি থেকে নেমে অভিভাবকদের কথা শোনেন এবং আমাদের যাতে বড় ধরণের (গুরু) শাস্তি দেওয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করেন।
জীবদ্দশায় তিনি আরও বলে গেছেন, ‘স্থানীয় সাংবাদিকদের লেখা-লেখির কারণে খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় ২০১০ সালে তার নির্দেশে মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমি ও নজির বিশ্বাস এ দুজনকে ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মাননা দেওয়া হয়। এরপর থেকে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আমরা মহান শহীদ দিবসে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফুলেল সংবর্ধনা ও সামান্য সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছি মাত্র। কিন্তু রাষ্টীয়ভাবে ভাষা সৈনিকের স্বীকৃতি পাইনি।’
ইসমাইল হোসেন বরাবরই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতি আর সমাজ সেবার মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ সময় পার করেছি। আমি মাত্র দেড় বছর একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেছি। ভালো লাগেনি, তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে মোট ২৯ বছর মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ১৩ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে আছি। বর্তমানে আমি অসুস্থ। ওষুধ খেয়ে কোনরকম টিকে আছি।’