কানিছ সুলতানা কেয়া
সময়টা ২০১২ সাল। টিউশনি করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যেত। ততক্ষণে হলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে। কত রাত যে রোকেয়া হলের সামনে বসে থেকেছি তার হিসাব নেই। তারপর আবার টিউশনিগুলোও একে একে কমতে থাকে। আমি ছিলাম জিওগ্রাফির ছাত্রী তাই টিচার হিসেবে আমার চাহিদাও ছিল কম। বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্য চাইতেন সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের স্টুডেন্টদের টিচার হিসেবে।
তাই হলের রুমে বসে কিছু করা যায় কি না তাই ভাবছিলাম। যেটাতে ইনকামও হবে আবার রাত করে হলেও ফিরতে হবে না। নিজের পড়াশোনাটাও করা যাবে ভালোমতো। ভাবতে ভাবতেই মাথায় আসে স্কিন, হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টের কথা। কারণ সে সময় আমিও স্কিনের অনেক সমস্যা ফেস করেছি এবং ঘরোয়া উপাদান ব্যবহার করে উপকার পেয়েছি।
তখন ফেসবুকে সেলার ছিল হাতেগোনা। নিজেরও একটা পেজ ছিল সিস্টার ওয়ার্ল্ডস। যেখানে স্কিন, হেয়ার কেয়ারের নানা টিপস শেয়ার করতাম। কিন্তু অন্যরা সেই প্রোডাক্টগুলো আমাকে ব্যবস্থা করে দিতে বলতো। সেখান থেকেই শুরু। এভাবেই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কাহিনি বলছিলেন মনিরা সুলতানা মায়া।
এখন তিনি সফল নারী উদ্যোক্তা। স্কিন ও হেয়ার কেয়ার হোমমেড প্রোডাক্টের পাশাপাশি কাপড়ও বিক্রি করছেন। বিশেষ করে নারীদের আন্ডার গার্মেন্টসে বেশ সাড়া পেয়েছেন তিনি। অনলাইনে আন্ডার গার্মেন্টস নিয়ে কাজ করার সাহস খুব কম উদ্যোক্তাই দেখিয়েছেন। তারমধ্যে তিনি অন্যতম।
এছাড়াও বেবি প্রোডাক্টও পাওয়া যায় তার পেজে। এবারের শীতে তিনি ভেজালমুক্ত খেজুরের গুড় এনেছিলেন তার ক্রেতাদের জন্য। মাত্র তিনদিনেই লাখোপতি হয়েছিলেন মায়া। ২ মাসে গুড় বিক্রি হয়েছে ৪০০ কেজির বেশি। যা দেশে ও দেশের বাইরেও গিয়েছে। ৫-৬ টি পেজ এবং গ্রুপ আছে ফেসবুকে। প্রথম সিস্টার ওয়ার্ল্ডস গ্রুপ দিয়েই শুরু। সেটা ২০১৪ সাল।
মনিরা সুলতানা মায়া অনলাইন জগতে যে কয়জন সফল নারী উদ্যোক্তার নাম তিনি পরিচিত এক নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করেছেন। সরকারি চাকরির পেছনে অন্যদের মতো তিনিও ছুটেছেন কিন্তু অনেক আগে থেকেই যেহেতু তিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন তাই সেই পথ থেকে সরে এসেছেন। নিজে কিছু করবেন এই ভাবনা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া মায়ার ছোটবেলা থেকেই। ক্লাস সেভেনে থাকতেই তাই হাত খরচের জন্য টিউশনি করতেন।
স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা মো.ওয়াসিম ও ছেলে মায়ানকে নিয়ে থাকেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মায়া সবার বড়। বেড়ে ওঠা চুয়াডাঙ্গা নিজের গ্রামেই। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় কেটেছে নানা বাড়িতে। ছোট থেকেই হাতের কাজে পারদর্শী ছিলেন স্থানীয় এক এনজিওতে কাপড়ে বাটিক, ব্লক, বিভিন্ন সেলাই শিখেছিলেন। নিজের খরচ চালাতে রাত জেগে কাগজের ঠোঙ্গা বানিয়েছেন। সেই টাকা জমিয়ে টিউশনির টাকা দিয়েছেন। এভাবেই এইচএসসি পরীক্ষার পর চলে আসেন ঢাকায়। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে মায়ার ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মেনে নিতে পারেনি কেউ। তার স্বামী এবং বাবা-মা সবার কাছ থেকেই প্রথমে এই ব্যাপারে নানান কথা শুনতে হয়েছে। তারপরও তার স্বামী তাকে একটি সুযোগ দেন। হাতে ১০ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে সময় দেন এক সপ্তাহ। এরমধ্যে তার টাকা ফিরিয়ে দিতে পারলে তিনি মায়ার ব্যবসার কাজে আর বাধা দেবেন না।
বলতে হয়, ভাগ্য সহায় হয়েছিল মায়ার। প্রথম অর্ডার এসেছিল ২২টি। ব্যাংকার স্বামী স্ত্রীর প্রতি ভরসা করলেন। অনুমতি দিলেন তার স্বপ্ন পূরণের। এখন সবসময় স্ত্রীর কাজে উৎসাহ দেন, পাশে থাকেন। তবে পণ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং, ডেলিভারি এজেন্সির কাছে পৌঁছে দেওয়া সব কাজ মায়া একা হাতেই করেছেন। এখন তার সঙ্গে কাজ করেন আরও ৫ জন। যাদের মাসে বেতন দেন মায়া।
এখন মাসে ইনকাম প্রায় লাখ টাকা। যা দিয়ে পরিবারের পুরো ভরণ-পোষণ করেন, ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ চালান এবং বাকিটা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেন।
মায়া বলেন, নিজের ব্যবসায় লাভ ক্ষতি সবই তার। কিন্তু নিজের জন্য একটি বেতনের ব্যবস্থা রেখেন। সেই টাকা দিয়েই তিনি তার ব্যক্তিগত খরচ করেন। এটাও তার একধরনের চাকরি বলা যায়। নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেও কর্মী।
মায়া এখন নিজের ব্যবসায়ের পাশাপাশি অন্যদের অনলাইন ব্যবসার খুটিনাটি শেখান। এজন্য তার রয়েছে বিজহাব বিডি এই নামের একটি পেজ। সেখানে নতুন উদ্যোক্তাদের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন টিপস দিয়ে সাহায্য করেন। এছাড়াও ফ্রি প্রোমোশন করেন নতুন উদ্যোক্তাদের পেজ। এছাড়াও তিনি গ্রামের দুঃস্থ নারীদের সেলাই মেশিন কিনে দেন, কখনো বা তাদের ব্যবসার কাজে আর্থিক এবং মানসিক সাহস দিয়ে সাহায্য করেন।
প্রতি বছরই তিনি এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রমের মানুষদের সাহায্য করেন। যে কার্যক্রম নির্দিষ্ট একটা সময়ের জন্যই না চলে সারাবছর।
মায়ার স্বপ্ন একটি প্রতিষ্ঠান হবে তার যেখানে কাজ করবে সমাজের অসহায় নারীরা। গ্রামের বিধবা নারী হতে পারেন কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের স্কুল পড়ুয়া। তারা কাজ করবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। অন্যের উপর ভরসা করতে হবে না। এছাড়াও তিনি চান অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে তিনি করতে চান প্রতারকমুক্ত।
ক্রেতাদের তার প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থাই তার ব্যবসায়ের পুঁজি। তবে শুধু বিক্রেতা হিসেবেই নয়, ক্রেতা হিসেবেও অনলাইনে ঠকেছেন তিনি। অনলাইনে তিনি নিজেও কেনাকাটা করেন সব সময়। তবে থেমে থাকেননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বারবার।
নতুন যারা অনলাইনে ব্যবসা করতে চান তাদের জন্য মায়া বলেন, অনলাইনে তো এখন অনেকেই ব্যবসা করে লাখোপতি হচ্ছে। আমিও হবো এই মানসিকতা একেবারেই দূর করতে হবে। কেউ সফল হয়েছে তার মানে এই না যে আপনিও সেই কাজে সফল হবেন। আপনি যে কাজ পারেন তাই দিয়েই অনলাইনে কাজ করুন। ভালোভাবে পড়াশোনা করুন। পেজে একটিভ থাকুন সব সময়। দীর্ঘমেয়াদি একটা প্ল্যান করুন। সেভাবেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। অবশ্যই আপনি সফল হবেন।