রবিউল ইসলাম রবি ॥ ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত এবং ফারসি- দুই ভাষাতেই রয়েছে। সংস্কৃতে ‘হাল’ অর্থ ‘লাঙল’, অন্যদিকে ফারসিতে ‘হাল’ অর্থ হচ্ছে ‘নতুন’। হালখাতার ইতিহাস কৃষি প্রথার সঙ্গে সম্পর্কিত। কারণ কৃষি প্রথার সূচনার পর হাল বা লাঙল দিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের পর সেই পণ্য বিনিময়ের হিসাব একটি বিশেষ খাতায় লিখে রাখা হতো, যেটি ‘হালখাতা’ হিসেবে পরিচিত। মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করার পর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে হালখাতা শুরু থেকেই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ও অপরিহার্য অংশ ‘হালখাতা’। শুধু হাল খাতাই নয় কালের বিবর্তনে ‘হালখাতা’ এর মতই অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে একটি দেশের ধারক ও বাহক বা একটি মাতৃভূমির প্রাণ বলা হয়। দেশের প্রাণকে সজাগ ও সতেজ রাখতে সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সম্প্রতিকালে বিশ্বায়নের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বরিশালের নগর ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি।
“ফিরে চল মাটির টানে”- এ স্লোগানে বরিশালে সোমবার (১৪ এপ্রিল) বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ পালিত হয়। বরিশাল উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে নগরীর ঐতিহ্যবাহী ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখি মেলা ও প্রভাতি অনুষ্ঠান। সংগঠনটি আনন্দ শোভাযাত্রায় হাতি, ঘোড়া, ফুল ও বাংলাদেশের পতাকার প্রতিকৃতি প্রদর্শন করে। পরে চারুকলা বরিশালের আয়োজন সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসন ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে (ববি) সহ রাজনৈতিক এবং নানা সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে পৃথক পৃথক আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যকর্মী ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। অনুষ্ঠানে গান, নাচ ও আবৃত্তি করেন শিল্পীরা।
অনলাইন নিউজ পোর্টালের হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, মুলাদি, গলাচিপা, নলছিটি, ভান্ডারিয়া ও স্বরুপকাঠি উপজেলা সংবাদদাতার জানিয়েছেন- তাদের এলাকায় কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পূর্বের ন্যায় বাংলা নববর্ষে ‘হালখাতা’ হয়েছে। একাধিক ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- এক প্রজন্ম আগে অর্থাৎ ২৫ বছর পূর্বেও মহাধুমধামে ‘হালখাতা’ পালিত হতো। সেই সময় সকল মানুষের চিন্তা ছিল বছরের শুরুতে দেনা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের মন থেকে সেই রীতি উঠে গেছে। কারণ- ‘হালখাতা’ এর আয়োজন করলেও বর্তমানের সিংহভাগ মানুষ পুরাতন দেনা পরিশোধ করে না। সমস্যার কথা বলে আরো অনুষ্ঠানে এসে খাবার খেয়ে যায়। যে কারণে ব্যবসায়ীরা আরো উলটো আর্থের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা আরো বলেন- করোনা মহামারি ও এরপর গত দুই বছর ঈদের ছুটির মধ্যে পহেলা বৈশাখ হওয়ায় সেভাবে হালখাতা করা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চৈত্র সংক্রান্তিতে হালখাতার চিত্রও পূর্বের ন্যায় বরিশালে দেখা যায়নি বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে। স্থানীয় সংগঠন সহ সরকারি-বেসরকারি কিছু সংখ্যক অফিসে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের নামে খাওয়া হয়েছে- ইলিশ ও পান্তা। গ্রাম-গঞ্জে নবান্ন উৎসবে টেঁকি চাটা চাল দিয়ে পিঠাপুলির আয়োজন থাকতো। এখন পিঠাপুলির স্থান দখল করে নিয়েছে বার্গার, পিজ্জা, চিকেন ফ্রাই, হালিম ও বিরয়ানী নামক খাবার। সেই টেঁকি ও পিঠার সাথে কালের বিবর্তনে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি।
এক সময়ে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন ছিল বায়োস্কোপ দেখা। বায়োস্কোপ দেখিয়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আনন্দ দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সংসার চালাত এই পেশায় নিয়োজিত মানুষ। বায়োস্কোপ বিনোদন মাধ্যম বিলুপ্তির পথে। এখনও মাঝেমধ্যে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় হয়। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বায়োস্কোপ পেশার লোকেরা পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন।
বাংলা লোকসংগীতের শক্তিশালী ‘ঐতিহ্যবাহী ধারা’ ভাটিয়ালি গান। প্রযুক্তির নানান সুবিধার কারণে এবং এসব গান সংরক্ষণের অভাবে এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীলতা, মানব-ভাবনা ও কাব্যত্ব না থাকার কারণে এ যুগের পাঠক তা পাঠও করেন না। তবে এখনো কোথাও কোথাও পুঁথিপাঠের আসর চলে। গাড়িয়াল ভাইয়ের জন্য এখন আর কেউ পথ চেয়ে থাকে না। আশ্বিন মাস এলেই নদীতে নৌকাবাইচ হতো, নদীর ধারে বসতো মেলা। এই মেলা থেকে কত রকম নকশা করা মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনা হতো, দেখতে পাওয়া যেতো পুতুল নাচের মতো মনোরঞ্জনমূলক নানা আয়োজন। এখন মেলা হলেও আগের মত তেমন উৎসব মুখর মেলা হয় না, নৌকাবাইচও হয় না, হয় না পুতুল নাচ।
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার গ্রামবাংলার একসময়ের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম ছিল হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, সাপখেলা, লাঠিখেলা, লুডু ও কড়িখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, পুতুল বৌ, ফুল টোক্কা, বাঘ-ছাগল, বরফ পানি, ষোলোগুটি, এক্কা দোক্কা, সাত-পাতা, দাপ্পা, চারগুটি সহ হাজারো খেলা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এসব ঐতিহ্যবাহী খেলার ন্যূনতম পরিচয়ও নেই। চর্চার অভাবে এসব খেলা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে খেলাধুলা মানে কম্পিউটার ও মোবাইল গেমস, আর বাচ্চাদের কাছে বিনোদন মানেই কার্টুন এবং আধুনিক ডিভাইস।
বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রাপালা, হুদমা গান, জগের গান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, জারি গান, মালশা গান, পালাগান, মুর্শিদি, মারফতি, ফকিরি, বিয়ের গীত ইত্যাদি। এগুলো নানান উপলক্ষ্য নিয়ে রচিত হত। কিন্তু এখন আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের ফলে বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত নয়, হিন্দি, ভোজপুরি, তামিল, ডিজে গান শোনানো হয়। কোথায় সেই চিরচেনা সংস্কৃতি, যে সংস্কৃতি নিয়ে দেশ বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক, লেখক, নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ কবিতা লিখা রয়েছে, সেই সাথে বহু বিদেশি পর্যটকও বাংলাদেশকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি হল দেশের প্রাণ। আর সেই প্রাণ যদি বিলুপ্তির পথে যায়,তাহলে সে দেশে বসবাস অযোগ্য হয়ে যাওয়ার মতো। তাই দেশের ফুসফুস খ্যাত লোকসংস্কৃতি রক্ষায় দেশ ও বাঙালি জাতি তৎপর হতে হবে। নিজের দেশের সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের। নিজ-সংস্কৃতি রক্ষার্থে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব জাতির নিজেরই।
সচেতন মহল বলছেন, গবেষক, শিল্পী, পৃষ্ঠপোষক এবং অবশ্যই শ্রোতা মহল সহ সকলকেই এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা তো প্রয়োজনীয় বটেই, কিন্তু সব থেকে যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা হলো বর্তমানের শিল্পীদের বাংলা তথা বাঙালি শিল্পের প্রতি গভীর ভালোবাসা। কারণ হাজার প্রতিকূলতার মাঝেও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন শিল্পী, কলাকৌশলী, শুভানুধ্যায়ী। দেশের উন্নয়নে আধুনিকায়নের প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু সেই আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যাওয়া কাম্য নয়। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায় সজাগ হতে হবে।
তারা আরো বলেন- বিশ্বায়নের স্রোতে গাঁ ভাসিয়ে হারিয়ে ফেলা যাবে না আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই বাঁচতে পারে আমাদের চিরপরিচিত লোকসংস্কৃতি। এর জন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। লোকসংস্কৃতির প্রয়োজন আছে তা বোঝাতে হবে। যে সকল দারিদ্র্য লোকজন বাঙালির আদি সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় তাদের কে পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। সংস্কৃতি আমাদের তাই রক্ষা করার দায়ভারও আমাদেরকেই নিতে হবে।