দেশকে আরেকটি ‘গৌরব’ এনে দিলো আ.লীগ সরকার

:
: ৯ মাস আগে

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বাংলাদেশকে আরও একটি গর্বের উপলক্ষ এনে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (আরএনপিপি) জন্য বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো বাংলাদেশ।

 

বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে আয়োজিত হস্তান্তর অনুষ্ঠানে (গ্রাজুয়েশন সেরিমনি) স্বপ্নের প্রকল্পটির রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম আরএনপিপি কর্তৃপক্ষের কাছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি হস্তান্তর করে।

বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের কাতারে সামিল হওয়া এবং বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের দিন।

 

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সফল পরিণতি লাভ করছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬-৫৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের  শিল্প,  বাণিজ্য,  শ্রম,  দুর্নীতিরোধ  এবং  গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রী থাকাকালে  এ অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্পায়নের ওপর জোর দিয়ে নানা উদ্যোগ হাতে  নিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে পশ্চিম  পাকিস্তানে একটি এবং পূর্ব বাংলার রূপপুরে একটিসহ মোট দু’টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

 

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র সম্পদ, এমনকি খনিজ সম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন এবং বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে আমাদের গ্যাস ফিল্ডগুলো কিনে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রূপপুর পারমাণবিক  বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে অনুযায়ী কিছু কাজও হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর এই মেগা প্রকল্পটিসহ সব জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট ও পলিসি স্টেটমেন্ট অন  পাওয়ার সেক্টর রিফর্মস’ প্রণয়নও অনুমোদন করে। সরকার জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। ‘বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান-২০০০’ প্রণয়ন করে। ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি  সংস্থা-আইএইএ’র সহযোগিতা চায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, বিষয়টি যেহেতু আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ছিল, সে কারণে জটিল আইন-কানুন তৈরি করতেই আমাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেওয়া সব জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি/প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। তবে ২০০৮ সাল থেকে পরপর ৩ দফা সরকারে থাকার কারণেই আমরা আজ বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য  হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি।’

 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। রাশিয়া থেকে একটি বিশেষ এয়ার কার্গোর মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের চালানটি ঢাকায় এসে পৌঁছায়। পরদিন কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সড়কপথে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। রাশিয়ার একটি কারখানা থেকে সরাসরি একটি বিশেষ বিমানে করে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পারমাণবিক জ্বালানি পাঠানো হয়।

রাশিয়ার নভোসিবির্সক কেমিক্যাল কনসেনট্রেট প্ল্যান্টে (এনসিসিপি) এই জ্বালানি উৎপাদিত হয়, যা রোসাটমের জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তেভেলের সহায়ক প্রতিষ্ঠান। রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুটি ইউনিটে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে।

 

বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের পারমাণবিক চুল্লি ২০২১ সালের অক্টোবরে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য চুল্লি ২০২২ সালের অক্টোবরে বসানো হয়। সরকার ২০০৯ সালে আরএনপিপি প্রকল্প স্থাপনের ধারণাটি হাতে নেয় এবং ২০০৯ সালের ১৩ মে রাশিয়ার সঙ্গে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে।

২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে নির্মাণকাজ সম্পাদনের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রাষ্ট্রীয় রপ্তানি ঋণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৫ সালে মস্কোর সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাধারণ চুক্তি (জিসি) সই করে সরকার। বাংলাদেশ ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আরএনপিপির জন্য ১১ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে রাশিয়ার সঙ্গে একটি আর্থিক চুক্তি সই করে। প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ এই অর্থ।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, রাশিয়া থেকে আসা ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘পারমাণবিক স্থাপনার’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশনের (আইএইএ) গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২৫ সালের শুরুতে রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ পাবে দেশের জনগণ। সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি হওয়ার পরই পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে। উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জনগণ এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে।

২০২৪ সালের মার্চে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে। আর দ্বিতীয় ইউনিটেও ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সমপরিমাণ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পটির উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হবে। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণে উল্লেখযোগ্য রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, নিউক্লিয়ার জ্বালানি আসার পরই রূপপুর পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম সদস্য দেশ। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হবে। এর প্রায় ১০ মাস পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে। ২০২৫ সালে গ্রাহকরা এখান থেকে বিদ্যুৎ পাবেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার আর বিশ্বসেরা প্রকৌশলীরা কাজ করেছেন জানিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, এর রক্ষণাবেক্ষণে দেশটি বন্ধুপ্রতীম দেশ বাংলাদেশকে আজীবন সেবা দিয়ে যাবে।

পূর্ণমাত্রায় উৎপাদনে যাওয়ার পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণে সক্ষম হবে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

পুতিন বলেন, প্রকল্পটি নির্মাণের সময় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর বিশ্বসেরা প্রকৌশলীরা কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশনের নিয়ম আর সুপারিশ পুরোপুরি পালন করা হয়েছে। রাশিয়া শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে না, এই প্রকল্পের পুরো লাইফ সাইকেলে আমরা বাংলাদেশের পাশে থাকবো। পারমাণবিক জ্বালানির টেকসই সরবরাহ করা কারিগরি সেবা ও ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব রাশিয়া গ্রহণ করেছে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপে উত্তরণ উপলক্ষে সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, এ প্রকল্পে আমাদের দুই দেশের স্বার্থ জড়িত এবং এটি পরস্পরের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও গভীর করেছে।