দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক পাওয়ারপ্ল্যান্ট: উচ্চাভিলাষী হতে পারে বাংলাদেশ

:
: ৬ years ago

অনলাইন ডেস্ক: গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (পাওয়ার প্ল্যান্ট) তৈরির আগ্রহ প্রকাশ দেখে বলেছিলাম, আমাদের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের দক্ষিণাঞ্চলে হলে ভালো হবে; দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও কেন্দ্রের নিরাপত্তা বিবেচনায়। উত্তরবঙ্গের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বর্তমান সময়ের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয় বলে অনেক বিশেষজ্ঞের মত। ৮ অক্টোবর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন, ‘বরিশাল বিভাগের কয়েকটি দ্বীপে জরিপ চলছে, সেখানে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয়া হবে।’ এটা বেশ ভালো সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের আমলা প্যানেল কৌশলগত স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগের তুলনায় দক্ষতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রুপের মেম্বার্সদের (পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহ গোষ্ঠী) মিটিংয়ে ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্তিমূলক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবনায় ভারতের এনপিটি (পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি) সাইন না করার অজুহাত দেখিয়ে চীন অতীতের মতো এবারও প্রস্তাবটিতে ভেটো দিয়ে প্রপোজালটি খারিজ করে দিয়েছে এবং তাদের এমন ভেটো দিতে থাকাই সঙ্গত সাউথ এশিয়ান রাষ্ট্রগুলোতে ভারতের বাণিজ্যিক প্রভাবকে খর্ব করার নিমিত্তে। সুতরাং ২০১৬ সালে চায়নিজ প্রিমিয়ার শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় স্ট্র্যাটেজিক্যাল এনার্জি এফিশিয়েন্সি ইনভেস্টমেন্টের জন্য স্বাক্ষরিত মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (সমঝোতা স্মারক)-এর সুবাদে বাংলাদেশে সেকেন্ড নিউক প্ল্যান্টের (দ্বিতীয় পারমাণবিক প্রকল্প) কাজটা রাশিয়ার পর চায়নার হাতে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কেইপ্যাবিলিটিকে রিজিওনাল ডিটারেন্টের লেভেলে নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিউক নন-প্রলিফিরেশন ট্রিটিতে সাইন করা সত্ত্বেও নিউক ফায়ার পাওয়ার (পারমাণবিক অস্ত্র) অর্জনের কৌশলগত সক্ষমতা অর্জন অত্যাবশ্যক হেতু এর জন্য তিনটা জিনিস ইনেভিটেবল। সেগুলো হচ্ছে—

(১) সাস্টেইনেবল অ্যান্ড ইনক্রেজিং ইকোনমিক গ্রোথ (টেকসই ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি)

বিগত কয়েক অর্থবছরের বাজেট, জিডিপি এবং এফডিআই বিবেচনায় ২০২৫/২০৩০ সাল পর্যন্ত জিডিপির কনজিকিউটিভ নিউম্যারিক গ্রোথ বহাল রাখা গেলে এবং পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে জিডিপির কোয়ালিটি জিওম্যাট্রিক গ্রোথ এট্টেইনমেন্টের ব্যাপারে ডিসকার্সিভ অ্যাসিওরেন্সের ফলশ্রুতিতে উইট্টি ইকো-স্ট্রাইডস পারসুএইড করা গেলে বিগ ইনভেস্টমেন্টের নিশ্চয়তা তৈরি হবে, যেটা সক্ষমতা তৈরির ফুয়েল হিসেবে কাজ করবে। এ জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকাও জরুরি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এমন বড় পদক্ষেপের জন্য অনুঘটক হিসেবে যথেষ্ট নয় এবং ২০২০ সাল নাগাদ অষ্টম ও নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পদক্ষেপসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মাথায় না রাখলে সেটা কতটুকু অ্যাফেবল হবে নিকট ভবিষ্যতে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামীর বাস্তবতা।

(২) প্রলিফিক ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি

বাংলাদেশে সফট ফায়ার আর্মস ও লাইট ভেহিক্যাল প্রোডাকশনের (হালকা অস্ত্র তৈরি ) জন্য গাজীপুরের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি আছে। গত বছর নিউজে দেখেছিলাম বিওএফের নতুন ব্রাঞ্চ ওপেন হবে সাউদার্ন (দক্ষিণ) সাইডে, পরে বিওএফ জিএম (সিকিউরিটি) নুর হক ভাই জানালেন খবর ঠিক নয়। জিডিপি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এক্সট্রিমলি হার্ড ডিটারেন্টে পারচেজ ছাড়া মিডিওকার লেভেলের ডিটারেন্ট তৈরিতে পাকিস্তান-চীনের মতো জয়েন্ট ভেঞ্চারে আর্মস ইকুইপমেন্টের প্রোডাকশন (যৌথ উদ্যোগে অস্ত্রাংশ উৎপাদন) শুরু করা যায়। এ ক্ষেত্রে এনলিস্টেড (তালিকাভুক্ত) করা যায় চায়না, পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে; এমনকি ভারতকেও, যদি টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস অনুকূলে থাকে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই খুলনা শিপইয়ার্ডে ইন্ডিজেনাসলি (দেশীয় প্রযুক্তিতে) দুটি ওয়ারশিপ ও দুটি সাবমেরিন টাগবোট নির্মাণ করেছে, যেগুলো গত বছরের নভেম্বর মাসে কমিশন্ড করেন মাননীয় প্রেসিডেন্ট। চীনের সঙ্গে জয়েন্টলি ছয়টি ইন্ডিজেনাস গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট নির্মাণের কথা হয়ে আছে চিটাগাং ড্রাইডকসহ অন্যান্য শিপইয়ার্ডে। সুতরাং, নিকট ভবিষ্যতে শর্ট রেঞ্জের সারফেস টু সারফেস অ্যান্ড এয়ার মিসাইল, হুইটজার, এমবিটি, আর্মার্ড ভেহিক্যাল (সাঁজোয়া যান), অটোমেটিক ফায়ার পাওয়ার্ড গানবোটের মতো ইকুইপমেন্টগুলো নিজেদের তৈরির সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

(৩) অ্যাফেবল নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, জিটুজি কমিউনিকেশন অ্যান্ড লোকাল ফ্যাসিলিটি

প্রথমত, এর জন্য দুই দশকের পরিকল্পনা নিয়ে প্রতি বছর একটা সলিড (শক্ত) বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের মাঝে দেশের সেরা ছাত্রদের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় বিশ্বের প্রধান ১০/১৫টা নিউক্লিয়ার রিসার্চ ফ্যাসিলিটিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরা এই শর্তে যাবে যে, দেশের কোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে এদের ডাক পড়লে ফিরবে। একই সঙ্গে বিশ্বমানের এক বা একাধিক নিউক ল্যাবরেটরি তৈরির পদক্ষেপও খুব দ্রুত নেওয়া প্রয়োজন। শর্ট নোটিশে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বানিয়ে দিতে সক্ষম নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও ইন্ডিজেনাস নিউক ফ্যাসিলিটি মজুদ এবং পিরিফায়েড ইউরেনিয়াম মজুদ থাকলে নিউক ফায়ার পাওয়ার অর্জন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে গত বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরের সময় পরমাণু সহযোগিতাসংক্রান্ত একটি মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং সাইন (সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর) হয়েছে। এমন জিটুজি (সরকার টু সরকার) মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং চীন, জাপান, তুরস্ক, ইউক্রেন ও অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম এনএসজি মেম্বার দেশগুলোর সঙ্গেও হতে পারে অথবা বলা চলে হওয়া উচিত। এতে আসন্ন সময়ে বাংলাদেশের নিউক প্ল্যান্টগুলোতে জাপানের ফুকুশিমা দাইচির পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিজাস্টারের (পারমাণবিক দুর্ঘটনা) মতো কোনোরূপ প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটলে একক বা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিপরীতে বিভিন্ন দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পাওয়ার আন্তর্জাতিক আইনি সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে।

তৃতীয়ত, ধারণা করা যাচ্ছে, দ্বিতীয় নিউক প্ল্যান্টের কলেবর ও প্রোডাকশন অ্যাফেবিলিটি (উৎপাদন ক্ষমতা) প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর নিউক প্ল্যান্টের চেয়ে বেশি হবে। পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রকল্প হাতে নিলে প্ল্যান্টের পাশে বা নির্মাণাধীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাবনাবাদ নেভাল বেসের (নৌঘাঁটি) আশপাশে কোনো নিরাপদ স্থানে একটি নিউক ফ্যাসিলিটি (পরমাণু স্থাপনা) স্থাপন করা যেতে পারে ইনিশিয়াল স্টেজে (প্রাথমিকভাবে)। এতে প্ল্যান্ট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষমতার উত্তরণও শুরু হয়ে যাবে।

সিরিল রেডক্লিফের সাব-কন্টিনেন্ট ভাগের পর যুদ্ধের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের পেটের ভেতর বাংলাদেশের জন্ম নেওয়া এবং হায়দরাবাদ ও সিকিমের মতো আত্মসমর্পণ না করে সদর্পে টিকে থাকা বাংলাদেশ নিউক ফায়ার আর্মসের সক্ষমতা অর্জন করুক—এটা ভারত তার নিজের দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই কোনোদিন চাইবে না। পাকিস্তান চাইতে পারে শত্রুর শত্রু বন্ধু থিওরিতে, কিন্তু এক্সট্রিম লেভেলের (পরম) রাষ্ট্রীয় সখ্য ছাড়া ওরা টুকটাক অ্যাডভাইসরি স্টেটমেন্ট (উপদেশমূলক) দেওয়া ছাড়া ক্রুশিও-টেকনোলজিক্যাল (প্রযুক্তিগত) কোনোরূপ অ্যাসিস্ট্যান্স (সাহায্য) বাংলাদেশকে দেবে না। চায়নার ব্যাপারটা অনেক প্রশ্নসাপেক্ষ, অন্তত কোরিয়ান পেনিনসুলার দিকে তাকালে দীর্ঘদিনের মিত্র ও লাগালাগি বর্ডার থাকা নর্থ কোরিয়ার (উত্তর কোরিয়ার) ইদানীংকালে চায়নাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা থেকেও বিষয়টি অনুমান করা যায়। অধিকন্তু নিউক সাবমেরিনের মতো নিউক আর্মস ভাড়া করা/ইমপোর্ট করার সুযোগ নাই হেতু নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের বিকল্পও নাই।

বাংলাদেশের পলিটিক্যাল এস্টাবলিশমেন্টস (রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত) ও ডিফেন্স ফোর্স যদি জয়েন্টলি (যৌথভাবে) একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করে, তবে ২০৪৫/৫০ সালের মাঝেই আমাদের পক্ষে নিউক ফায়ার আর্মস তৈরির সক্ষমতা অর্জন সম্ভব। গরিব একটি দেশ বিবেচনায় এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেকের চোখেই অসংলগ্ন বক্তব্য মনে হতে পারে। তবে আগামী সময়ে আমাদের হাতে একঝাঁক দক্ষ নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও দেশে উন্নতমানের নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি থাকলে ব্রহ্মপুত্রের কাদায় এবং সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাহাড়ে পাওয়া ৫০০ পিপিএম মাত্রার ইউরেনিয়ামকে সমৃদ্ধ করে উপরিউক্ত সময়ের মাঝেই নিউক ফায়ার পাওয়ার অর্জন করা যাবে বলে আমি মনে করি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গত দুই শাসনকালে নিজেকে একজন ভিশনারি লেডি (স্বপ্নদর্শী নারী) হিসেবে উপস্থাপন করেছেন বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানি নিরাপত্তা, যোগাযোগব্যবস্থার ক্রম-আধুনিকায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, কৃষিখাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, জিডিপিকে সাড়ে সাত শতাংশে পৌঁছানো ও ব্যালেন্সড ফরেইন পলিসি (ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি) গ্রহণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে। এই বিষয়গুলো থেকে প্রতীয়মান করা যায়, আসন্ন সময়ে এমন উচ্চাভিলাষী কৌশলগত সক্ষমতা অর্জনের নিমিত্তে ক্যালকুলেটিভ ডিসিশান (হিসেবি সিদ্ধান্ত) নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কামিয়াব (সফল) হবেন।