করোনা ভাইরাসের কারণে রাজধানীর সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না এমন খবর এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। ইত্তেফাকের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা এ তথ্য দিয়েছেন।
মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাস নিয়ে সংক্রমণের ভয়ে হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছে রোগী। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাধীন রোগী অর্ধেকে নেমে এসেছে। জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ১২ থেকে ১৫ জনের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন নেই। চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ রোগের সঠিক চিকিৎসাসেবা না মেলায় হাসপাতালে আগের মতো রোগীর ভিড় নেই। যারা চিকিৎসাধীন আছেন তারাও করোনা সংক্রমণ নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকেই নিজে রিলিজ নিয়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগেও রোগীর দীর্ঘ লাইন নেই। অতি জরুরি না হলে কোনো রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে না। যারা আসছে তারাও নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে স্বাভাবিক সময় যেখানে ২ হাজারের ওপরে রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন সেখানে বর্তমানে ১ হাজার ২০০ রোগী রয়েছে। জরুরি বিভাগে ফাঁকা অবস্থা বিরাজ করছে। হাসপাতালের বেড খালি না থাকায় রোগীদের ওয়ার্ডের ফ্লোরে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হতো। এখন যারা আছে তারা বেড পাচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরের দর্শনার্থীদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম ইত্তেফাককে বলেন, রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন না হলে ভর্তি হতে আসছে না। আমরাও রোগীর অবস্থা জটিল না হলে প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিয়ে রিলিজ দিয়ে দিচ্ছি। অধিকাংশ চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারও বন্ধ রেখেছে। বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম ইত্তেফাককে বলেন, রোগী আসলেও চিকিৎসা নিয়েই চলে যেতে তড়িঘড়ি করছে। তারা হাসপাতালকে নিরাপদ মনে করছে না। বর্তমানে জরুরি চিকিৎসাসেবায় সংকট বিরাজ করছে।
আনিসুজ্জামান, রাজশাহী থেকে জানান, করোনা ভাইরাস আতঙ্কে রাজশাহীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই রাজশাহী মহানগরীর ১১৮টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রায় চিকিৎসক শূন্য। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ওয়ার্ডে রাউন্ডেও যাচ্ছেন না। ফলে রাজশাহী মহানগরী জুড়ে চিকিত্সাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বর, পেটব্যথা, হৃদরোগ ও দাঁতের সমস্যাসহ বিভিন্ন সাধারণ রোগে আক্রান্তরা ন্যূনতম চিকিৎসাসেবাও পাচ্ছেন না। শুরুতে পিপিই সংকটকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল চিকিৎসকরা। বর্তমানে পর্যাপ্ত পিপিই পৌঁছালেও পরিস্থিতি উন্নতি হয়নি। অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে করোনা রোগীও আসতে পারে, এই ভয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রোগী দেখা বন্ধ করেছেন।
জ্বর ও সর্দি কাশি নিয়ে গত শনিবার বিকালে রামেক হাসপাতালে আসেন নওগাঁর রাণীনগরের অলংকার দীঘিগ্রামের আল আমিন (২২)। তার বাবা মোখলেসুর রহমানের অভিযোগ, রামেক হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিত্সকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কিছু ওষুধ ও ইনজেকশন লিখে দেন। সেগুলো কিনে দিলেও ছেলের জ্বর কমেনি। এরপর আর কোনো চিকিৎসক ছেলের আশপাশেও যাননি। একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় তার ছেলে মারা যায়।
শাহীন হাফিজ, বরিশাল অফিস থেকে জানান, দক্ষিণ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিকিত্সাসেবা প্রতিষ্ঠান বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পিপিই সংকটে ব্যাহত হচ্ছে সব ধরনের চিকিত্সাসেবা। বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রোগীরা। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সদর (জেনারেল) হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড থাকায় আতঙ্কিত রোগীরা সেখানে যেতে যাচ্ছে না। শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে সেখানে ১ লাখ পিপিইর চাহিদা দেওয়া হয়েছিল। সরবরাহ হয়েছে ১ হাজার ১৭০টি। রোগীরা এ হাসপাতালে ভর্তি হলে তাদেরকে সামান্য চিকিৎসা দিয়ে বিদায় করার অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় বহির্বিভাগে হাতেগোনা কয়েক জন রোগী অপেক্ষা করছেন চিকিৎসকদের কক্ষের সামনে। বেশির ভাগের কক্ষে চিকিৎসক অনুপস্থিত। যারা আছেন তাদেরও রোগীদের প্রতি আগ্রহ নেই। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী আব্দুল কাইয়ুম জানান, চিকিৎসকরা রোগীদের দূরে দাঁড় করিয়ে দুই/একটি কথা শুনে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিচ্ছেন অথবা মোবাইল ফোন নম্বর দিচ্ছেন পরে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাপত্র নেওয়ার জন্য।
সিলেট অফিস জানায়, করোনা ভাইরাসজনিত কারণে সিলেটের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী কমে গেছে। যারা অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এমনকি ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারও বন্ধ। অধিকাংশ চিকিৎসক ভয়ে রোগী দেখছেন না। বাজারের ফার্মেসিগুলোই এখন ভরসা। অনেকেই আবার পুরাতন প্রেসক্রিপশন ফলো করে ওষুধ খাচ্ছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর থেকে জানান, করোনা সংক্রমণের ভয়ে রোগী শূন্য হতে চলেছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। হাতে গোনা কয়েক জন রোগী থাকলেও তারা ঠিকমতো চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ বলে জানা গেছে। হাসপাতাল জুড়ে বিরাজ করছে ভূতুড়ে পরিবেশ। অথচ সপ্তাহ খানেক আগেও এই হাসপাতালে ছিল রোগীর কোলাহল। ভর্তি রোগীরা জানান, একটু সুস্থ হলেই তারাও বাড়ি চলে যাবেন। ডাক্তার, নার্স কাউকে ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। জরুরি বিভাগে থাকা এক রোগীর স্বজন বলেন, তিন দিন ধরে রিপোর্ট দেখানোর জন্য চেষ্টা করছি, কিন্তু ডাক্তার নেই। যারা আছেন, তারা কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না। বাহিরে যে প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে যাব, সেই উপায়ও নেই। বাইরের ডাক্তাররাও চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন।
শেখ মহিউদ্দিন আহাম্মদ, ময়মনসিংহ থেকে জানান, করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের কারণে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আন্তঃবিভাগে প্রায় ৭০ শতাংশ রোগী কমে গেছে। আতঙ্কে রোগীরা নিজেরাই ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন বলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা দাবি করেন। অপর দিকে অনেক রোগীদের অভিযোগ, এ সময় তাদেরকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না এবং জোর করে তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। করোনার ভয়ে নিয়মিত অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এখন চিকিৎসা দিতে আসছেন না। করোনা ভাইরাসের কারণে আতঙ্কে রোগী কমে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসপাতালে উপপরিচালক ডা. লক্ষ্মী নারায়ণ মজুমদার জানান, আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে সেখানে গতকাল সোমবার ভর্তি ছিল মাত্র ৮১৬ জন।
হাসপাতালের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল মাজেদ জানান, আগে রোগীর স্বজন ও দর্শনার্থীদের কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যেত না। করোনা ভাইরাসের কারণে হাসপাতালে দর্শনার্থী আসা বন্ধ হয়ে গেছে।