“সাকিবকে বড় আলেম বানানোর ইচ্ছা ছিল, অনেক চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যদিও সাকিব নিজে পুলিশ অফিসার হতে চেয়েছিল।” জুলাই শহীদ সাকিব রায়হানের পিতা শেখ মো. আজিজুর রহমান দুই চোখের পানি মুছতে মুছতে এভাবেই তার আদরের ছোট সন্তান সাকিব রায়হানের স্মৃতি রোমন্থন করেন। সাকিব হত্যার এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাবা-মায়ের চোখের পানি এখনও শুকায়নি।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে চব্বিশের ১৯ জুলাই শহীদ হন খুলনার সম্ভাবনাময় টগবগে তরুণ শেখ মো. সাকিব রায়হান (২০)। আজ ১৯ জুলাই সাকিব হত্যা বার্ষিকী।
সাকিবের মা নুরুন্নাহার বেগম সন্তানের ছবি হাতে নিয়ে তার শিশুকাল ও শৈশব-কৈশোরের নানান স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, “আমার ছেলে খাবার বা কোন কিছু নিয়ে কোনদিন আমাদের সঙ্গে জিদ করেনি বরং তরুণ বয়সেও সে একটি সহপাঠী বন্ধু গ্রুপের মাধ্যমে রক্তদান করত। বলতো, আমার রক্তের বিনিময়ে একজন মানুষ সুস্থ থাকবে। দুই তিন মাস পর পরই রক্ত দিত সে। এমনকি তার বড় ভাই সাব্বির রায়হানের জন্মদিন উপলক্ষেও সে রক্তদান করতো।”
সন্তানকে আদরের নামে ডেকে তিনি বলেন, “আমার পাখি’র সঙ্গে কত স্মৃতি রয়েছে, তাকে কীভাবে ভুলব? কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না।” এভাবে তিনিও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। খুলনা মহানগরীর নবপল্লী এলাকার বাসায় এসব কথা বলেন শহীদ সাকিব রায়হানের বাবা-মা।
সাকিব রায়হান গেল বছরের ১৯ জুলাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরের ফায়ার সার্ভিস গলিতে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে গুলি ও অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সাকিব ছিলেন ছোট। এ কারণে মা-বাবা ও বড় ভাই-বোনের সবচেয়ে বেশি আদরেরও ছিলেন তিনি।
সাকিবদের বাড়ি সংলগ্ন বায়তুল আকাবা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা রবিউল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, “সাকিব খুবই ভালো ছেলে ছিল। স্বভাব, চরিত্র ও আচরণ ভালো ছিল। তার মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি। হেসে কথা বলতো। তবে, বেশিরভাগ সময় সে ঢাকায় অবস্থান করায় এলাকায় কম দেখা যেত। কিন্তু বাড়িতে এলে মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসতো। তার মৃত্যুতে সবাই শোকাহত।”
সাকিবের জানাজা ও দাফনের স্মৃতি উল্লেখ করে মাওলানা রবিউল ইসলাম বলেন, “সাকিব রায়হান গত বছরের ১৯ জুলাই নিহত হয়। ওইদিন রাতেই তার লাশ খুলনায় আনা হয়। তখন কারফিউ জারি ছিল। যে কারণে নানা শঙ্কার মধ্যে পরদিন ২০ জুলাই ফজরের নামাজের পরই মসজিদ পার্শ্ববর্তী ফাঁকা জায়গায় দ্রুততার সঙ্গে জানাজা নামাজ পড়া হয়। জানাজা শেষে ভোরেই দ্রুত তাকে নগরীর বসুপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।”
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শহীদ সাকিব রায়হানের পিতা আজিজুর রহমান এ প্রতিবেদককে আরো বলেন, “সাকিব মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে বৃহস্পতিবার ঢাকায় তার বড় ভাই সাব্বির রায়হানের বাসায় আমরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করি। ওটাই ছিল ছেলের সঙ্গে আমার এবং তার মায়ের শেষ খাবার। এরপর শুক্রবার আমি এবং সাকিবের মা খুলনায় চলে আসি। সাকিবকে সঙ্গে আসতে বললেও সে রাজি হয়নি। ফলে কিছুটা অভিমান তৈরি হয় ছেলের প্রতি। খুলনায় আসার পথে গাড়িতে শাকিব ফোন করে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। ওটাই ছিল ওর সঙ্গে শেষ কথা। পরবর্তীতে সে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। যে কারণে একাধিকবার ফোন করলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
‘সর্বশেষ ১৯ জুলাই আসরের নামাজের পর সাকিবের এক বন্ধু আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করে সাকিব আপনার কী হয়? জবাবে সাকিব আমার সন্তান বলার পর আমাকে জানানো হয়, আপনার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে, একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠান, তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। এ খবর শুনে আমি জোরে একটি চিৎকার দিই। এরপর ঢাকায় যেয়ে আমার কলিজার টুকরা সন্তানের লাশ খুঁজে বের করে খুলনায় নিয়ে আসি। এরপর বসুপাড়া কবরখানায় দাফন করি।”
তিনি বলেন, “সাকিবকে বড় আলেম বানানোর জন্য ঢাকার একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। সেখানে সে ১৮ পারার হাফেজ হয়। কিন্তু নানা কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারেনি।”
তিনি আরো উল্লেখ করেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য নিজের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছে। সন্তানের এই বিদায় পিতা হিসেবে মেনে নেওয়া কষ্টের। তারপরও দেশ এবং মানুষের নতুন স্বাধীনতার কথা ভেবে সেই কষ্ট কিছুটা হলেও ভুলে থাকার চেষ্টা করি। এছাড়া ছেলের জীবনের বিনিময়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রশাসনসহ সকল মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা ও সম্মান পাচ্ছি এবং সবাই আমাদের বুকে টেনে নিচ্ছেন- এতে ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালোলাগা এবং কষ্ট কিছুটা হলেও সেদিন কমবে যেদিন আমার কলিজার টুকরা সন্তান হত্যার সঠিক বিচার পাব।”
সাকিবের মা নুরুন্নাহার বেগম আরও বলেন, “ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করে এবং তার বাবার সামান্য আয় দিয়ে তিনটি সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করেছি। তাদেরকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সাকিব সবসময় আমাদের নিয়ে চিন্তা করত। বিভিন্নভাবে ছোট ছোট চাকরি করে আয় করার চেষ্টা করত। আমি তাকে বারবার খুলনায় চলে আসতে বলতাম, কিন্তু সে বলতো ‘আম্মু খুলনায় ভালো লাগে না’। এ কারণে আমাকে ঢাকায় নিতে চেয়েছিল। সর্বশেষ মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ছেলের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়। ওই সময় সে আমাকে আন্দোলনে আছে বলে জানায়। তার বাবার দিকে খেয়াল রাখার জন্যও আমাকে বলে। এভাবে সে সর্বশেষ তার বাবা এবং আমার খোঁজ খবর নেয়।”
তিনি বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্ট আমার ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। বরং তার আগেই আমার সন্তান লাশ হয়েই আমার কাছে ফিরে এসেছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার ছেলের খুবই কম অর্থের চাহিদা ছিল। আমার মুখে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাত্র ২০ টাকা চাইতো। দিলে অনেক খুশি হতো। আবার কেউ চাইলে তাকেও সে দান করতো। ঢাকায় পড়াশোনা করার ফাঁকে তার বোন আন্নির বাসায় যেতো। তার রান্না সাকিব খুব পছন্দ করতো। বোনের হাতের রান্না খেয়ে সে আবার মাদ্রাসায় চলে যেত। এভাবে বোনের খুব আদরের ছিল সাকিব।”
শহীদ সাকিব রায়হানের বাবা-মা জানান, সাকিব রায়হান শহীদ হওয়ার পর থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- সরকার ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছে। যেখান থেকে প্রতি মাসে মুনাফা পান তারা।
এছাড়া জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং খুলনা জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
এর বাইরেও বিএনপি, এনসিপি ও গণধিকার পরিষদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা হয়েছে। এমনকি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তাদেরকে শুভেচ্ছা উপহার পাঠিয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা।