খুলছে স্কুল-কলেজ : শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিয়ে চিন্তা

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

করোনা মহামারির কারণে গত এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। আগামী ৩০ মার্চ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। চলমান ছুটির মধ্যে সংসদ টেলিভিশন, বেতার, কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি ভার্চুয়ালি শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হলেও তাতে অনেক শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে আগামী দুই থেকে তিন বছর সময় প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।

তারা বলছেন, অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হওয়ায় স্কুল-কলেজে উপস্থিতি কমে যাবে। মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি কমিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের শ্রেণি ক্লাসের সময় বাড়াতে হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে আলাদাভাবে তাদের শেখাতে হবে। এজন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মানী বাড়াতে হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মনিটরিং বাড়াতে হবে।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। কওমি মাদরাসা ছাড়া অন্যসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগামী ২৯ মার্চ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা আছে।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দিয়ে বলেন, পর্যায়ক্রমে প্রথমেই প্রাথমিকে হয়তো পঞ্চম শ্রেণিকে প্রতিদিন আনব। আমরা দশম ও দ্বাদশ শ্রেণিকে প্রতিদিন আনব। বাকি ক্লাসগুলো হয়তো প্রথমে সপ্তাহে একদিন, কয়েক দিন পর থেকে তারা সপ্তাহে দুদিন আসবে। পর্যায়ক্রমে আমরা স্বাভাবিকের দিকে নিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।’

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘সিক্স, সেভেন ও এইট (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি) গোড়ার দিকে সপ্তাহে একদিন করে আসবে। তারপর অবস্থা বিবেচনায় আমরা সেটা বাড়াব। যদি দেখা যায় টিকার কারণে দেশে একেবারেই কোনো সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে না, তাহলে তো আমরা দু-তিন সপ্তাহ পর থেকেই একেবারে স্বাভাবিক ক্লাসে চলে যেতে পারি। যদি দেখা যায় এখনও সংক্রমণের ঝুঁকি রয়ে গেছে, তাহলে তখন আমরা স্ট্যাগার করে যতদিন প্রয়োজন মনে করব আমরা করব।’

মহামারি পরিস্থিতির কারণে গত বছর পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী পরীক্ষা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া যায়নি। নতুন বছরে আগের রোল নিয়েই নতুন ক্লাস শুরু করবে শিক্ষার্থীরা।

 

উচ্চ মাধ্যমিকেও চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়া যায়নি। এইচএসসি ও সমমানের ফল ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের অষ্টমের সমাপনী এবং এসএসসি ও সমমানের ফলের ভিত্তিতে।

অনলাইনে ক্লাস চললেও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘমেয়াদি সেশনজটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রাজধানীর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা বাসায় বসে পড়ালেখা করলেও শ্রেণি ক্লাসে বসে শিক্ষকদের কাছে যে পদ্ধতিতে শিক্ষা পেয়ে থাকতেন, তা না পাওয়ায় পড়ালেখায় পিছিয়ে যাচ্ছেন। সচ্ছল পরিবারের অনেকে অনলাইনে কোচিং সেন্টার বা নামিদামি শিক্ষকদের কাছে ভার্চুয়ালি পড়ছেন। আবার অনেকের সে সুযোগ না হওয়ায় তারা পিছিয়ে পড়ছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে তারা এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।

জানতে চাইলে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় নানাভাবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজ খোলার ঘোষণা দেয়া হলেও ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব বেশি ঝুঁকি না থাকলেও ঢাকা মহানগরে সেই ঝুঁকি বেশি। সেজন্য প্রতিটি স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা দিলেই হবে না, তার জন্য সরকারি-বেসরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগ বেশি দেয়া প্রয়োজন। নতুবা এসব ছোট শিক্ষার্থীর মাধ্যমে নতুন করে আবারও মহামারি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ হারাবেন। এ জন্য স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুদিন ছুটি বাতিল করে একদিন করতে হবে।

পবিত্র রমজান মাসে শিক্ষার্থীদের ছুটি ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি।

করোনায় স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও শিক্ষা খাতে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে ভার্চুয়াল মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও তা থেকে অনেকে পিছিয়ে পড়েছে।

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সচ্ছল পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটের ওপর আসক্ত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আমাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম, অপুষ্টি ও পরিবারের মধ্যে অশান্তি বেড়ে গেছে। এসব কারণে ৭৬ শতাংশ অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ খোলার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর দাবি সবার’—বলেন তিনি।

এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে শুধু সরকারিভাবে ঘোষণা নয়, যাদের সক্ষমতা নেই তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা প্রয়োজন। সব স্থানে এটি নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও জনপ্রতিনিধিদের দক্ষতা প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য কড়া মনিটরিং প্রয়োজন। অভিভাবকদের আস্থা তৈরিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতে হবে। শিক্ষকদের দক্ষতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।

সবাইকে স্কুলমুখী করতে স্কুল-কলেজে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) মশিউজ্জামান জানান, ছাত্র-ছাত্রীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পরের বছরের পাঠের সঙ্গে পূরণের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নিচের ক্লাসের যে বিষয়টি না পড়ে কোনো শিক্ষার্থী উপরের ক্লাসে উঠেছে, নতুন ক্লাসে সে ধরনের বিষয় পড়ার সময় আগের ক্লাসের বিষয়টিও পড়ানো হবে। করোনা পরিস্থিতি কমে গেলেও ভার্চুয়াল ক্লাস অব্যাহত রাখা হবে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ের ডিজিটাল ভার্সন রাখা হবে, যেন শিক্ষার্থীরা যে কোনোভাবে সেগুলো আয়ত্ত করে নিতে পারে।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ কমিটির প্রণেতা অধ্যাপক ড. একরামুল কবির বলেন, ভার্চুয়াল মাধ্যম থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত। শহরকেন্দ্রিক এ সুবিধা পাওয়ায় স্কুল খুললেও শহরে বসবাস করা শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে স্কুল করতে চাইবে। স্কুলে উপস্থিতির বিষয়ে তাদের অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। বঞ্চিতদের চিহ্নিত করে আলাদাভাবে ক্লাস নিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসের সময় বাড়াতে হবে।

ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য মনিটরিং বাড়াতে হবে। মাত্র একদিন ক্লাস করে কোনো সুফল আসবে না। ছয়দিন পর একদিন স্কুলে উপস্থিত হলে পড়ার চেয়ে গল্পে তাদের সময় ব্যয় হবে। এ জন্য ক্লাসের পরিমাণ বাড়াতে হবে।