ক্ষতিপূরণের টাকাও নেই উন্নয়নও নেই

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

রাজধানীর কুড়িল এলাকায় ৩০০ ফুট রাস্তার উভয় পাশে ১০০ ফুট চওড়া খাল খননের নামে হুকুমদখল করা জায়গা-জমি পরিত্যক্ত অবস্থায়ই ফেলে রাখা হয়েছে। হুকুমদখলকৃত জায়গা থেকে বাড়িঘর, স্থাপনা সব ভেঙে দেওয়া হয়েছে; উচ্ছেদ করা হয়েছে বাসিন্দাদের। কিন্তু হুকুমদখলে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণের টাকাও পাচ্ছেন না, সেখানে কোনো উন্নয়নও হচ্ছে না। স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে জেলা প্রশাসন পর্যন্ত বিভিন্ন দফতরে মাসের পর মাস ধরনা দিয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ায় মানুষজনের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, বাপ-দাদার বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা রকম টালবাহানা চালানো হচ্ছে। হুকুমদখলকৃত স্থানে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড না হওয়ায় তারা বসতভিটা নিজেদের অনুকূলে ফেরত পাওয়ার দাবিও জানান। এদিকে পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফুট রাস্তার উভয় পাশে খাল খননসহ দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প নেয় সরকার। কিন্তু ঢিমেতালের কর্মকাণ্ডে প্রকল্প এলাকায় ‘দৃষ্টিকটু’ দৃশ্যপট গড়ে উঠেছে।

প্রকল্প এলাকা থেকে এরই মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাট। বুলডোজার ব্যবহার করে সেসব বিল্ডিং বাড়ির অর্ধাংশ ভেঙে ফেলায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে। কুড়িল এলাকায় ৩০০ ফুট রাস্তা-সংলগ্ন বাড়িঘরের দিকে তাকালেই যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীর চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। খাল প্রকল্পের জন্য ৯০ একর ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অধিগ্রহণের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এই হিসাবে প্রতি শতক জমির দাম পড়েছে ৪৮ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে এখনো নানা রকম টালবাহানা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতর পর্যন্ত বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। সেসব স্থানে চাহিদামাফিক টাকা দেওয়া না হলেই নামে-বেনামে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ওয়ারিশান সাজিয়ে দরখাস্ত প্রস্তুত করা হয়। সে দরখাস্তের অজুহাতেই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। কুড়িল কুড়াতলী এলাকার বাসিন্দা ভুক্তভোগী সেলিম জাবেদ জানান, শুধু জায়গা-জমির ক্ষেত্রে নয়, যেসব স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেসবের ক্ষতিপূরণও আদায় করা যাচ্ছে না। নানা অজুহাত সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিজের সিটি দাগ নম্বর ৩০৫১৯ উল্লেখ করে তিনি জানান, সেখানে তাদের তিন ওয়ারিশানের বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা ছিল। যুগ যুগ ধরেই সেখানে তারা বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু একজন ওয়ারিশান জেলা প্রশাসনের সহায়তায় একাই সমুদয় বিল উত্তোলনের পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের অভিযোগ দিয়েও এক ব্যক্তির নামে বিল না দেওয়ার আবেদন গ্রহণ করানো যাচ্ছে না।

প্রকল্পে ১০০ ফুট খাল ছাড়াও প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক, ৩৯ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, চারটি ইউলুপ, খালের ওপর ১৩টি সেতু, চারটি পদচারী-সেতু ও পাঁচটি স্লুুইস গেট নির্মাণ করা হবে। এ বছরের মধ্যেই খাল প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। খালের অপর পাশের বাসিন্দাদের ৩০০ ফুট রাস্তায় যাতায়াতের জন্য কিছু দূর পরপর দৃষ্টিনন্দন সেতু থাকবে, সড়কে থাকবে পর্যাপ্ত সংখ্যক ইউলুপ—ভূমি অধিগ্রহণের আগে এমন অনেক কথাই বলা হয়েছিল, স্থানীয় বাসিন্দাদের দেখানো হয়েছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। মূল প্ল্যানেও বিষয়গুলোর সংযুক্তি নেই। এখানে ভূমি অধিগ্রহণের শর্তগুলোও পালন করা হচ্ছে না। ভূমি অধিগ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, এ জায়গায় ১০০ ফুট চওড়া সচল পানির খাল হবে, পাড় বাঁধাইসহ চারপাশে গড়ে উঠবে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ করে বসতভিটা ভেঙে বাসিন্দাদের উচ্ছেদের পর এখন বলা হচ্ছে, সেখানে মাটির নিচ দিয়ে থাকবে প্রবহমান খাল আর ওপরে গড়ে উঠবে দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ।

এ জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা খরচের বিশাল প্রকল্পের কাজও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এমন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ আর নানা রকম টালবাহানায় মানুষজন চরম বিরক্ত-ক্ষুব্ধ। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, জমি অধিগ্রহণের মূল্য প্রদানের ক্ষেত্রেও পদে পদে তাদের ঠকানো হয়েছে। জায়গার ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে জায়গা-জমির বর্তমান বাজারমূল্য মোটেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এমনকি জায়গার দাম নির্ধারণে হাই কোর্টের দেওয়া নির্দেশকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বরুড়া মৌজায় খাল প্রকল্পভুক্ত স্থানে ডোবা-নালা প্রকৃতির প্রতি শতাংশ জায়গার দাম এক লাখ ৯৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে সেখানে প্রতি শতাংশ জমির দাম ১ কোটি টাকারও বেশি। ডুমনি মৌজাভুক্ত স্থানে ডোবাশ্রেণির প্রতি শতাংশ জায়গা এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে। বাস্তবে সেখানে জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৫০ গুণেরও বেশি।

৩০০ ফুট রাস্তার উভয় পাশে দুই বছর আগেও প্রতি কাঠা জমি দুই কোটি টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। এখন দাম আরও বেড়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই দলিল নম্বর-৫৮১১ মূলে আট কাঠা জমি বিক্রি হয় ১৫ কোটি টাকায়। এর আগের বছর ২০১৪ সালের ১৯ জুলাই দলিল নম্বর-৪৭৯ মূলে ১০ কাঠা জমি বিক্রি হয়। চার বছর আগে থেকেই প্রতি কাঠা জমি দেড়-দুই কোটি টাকায় কেনাবেচা হলেও সেসব জমি অধিগ্রহণকালে দেড়-দুই লাখ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর এখানকার জায়গার দাম নির্ধারণ করে তা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়ার জন্য হাই কোর্ট এক রায় দেয়। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সে রায়ও সুস্পষ্ট অমান্য করা হয়েছে। এটা আদালত অবমাননার শামিল বলেই মনে করেন আইনবিদরা। প্রাপ্য প্রকৃত ক্ষতিপূরণ যেমন নির্ধারণ হয়নি, তেমনি নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের যৎসামান্য টাকাও হাতে পাচ্ছেন না ভিটেমাটিহারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা।

এসব নিয়ে ক্ষোভ-হতাশার শেষ নেই। খাল প্রকল্পে জায়গা অধিগ্রহণের পর উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দারা অনেকেই এখন পর্যন্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে পারছেন না। অনেকেই বলছেন, পুরো বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, অনেক কষ্টের। এত কিছুর পরও তারা খাল প্রকল্প পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের কোনো নজির দেখতে পাচ্ছেন না। খালের কারণে আটকে পড়া বাসিন্দারা বাড়িঘর থেকে কীভাবে রাস্তায় বেরিয়ে আসবেন এরও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সর্বস্বহারা মানুষজনের মধ্যে ক্ষোভ-কষ্ট, উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। যে কোনো সময় উপায়ান্তরহীন মানুষজন রাস্তায় নেমে আসতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুরুতে খাল দুটি সড়কের প্রান্ত ঘেঁষে তৈরির কথা থাকলেও এখন এই খাল দুই প্রান্তে ৩২ ফুট করে সড়কের ভিতরে ঢুকে পড়ছে। ফলে ৩০০ ফুট রাস্তা বাস্তবে ২০০ ফুটেরও কম প্রশস্ততায় ঠেকেছে। প্রধান সড়কের দুই পাশে সার্ভিস রোড নির্মাণের কাজ শেষ হচ্ছে না ১৩ বছরেও। ভবিষ্যতে এ রাস্তার সঙ্গে রেলপথ সংযুক্তির প্রাক-পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া চার লেনে সড়ক নির্মাণের কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র দুটি লেনের নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সড়ক আইল্যান্ডগুলোর প্রশস্ততা বাড়িয়ে যথেচ্ছা নার্সারি করেও জবরদখল করা হয়েছে। সড়কের একাংশ দখল করে দোকানপাট, এমনকি বাজারও গড়ে উঠেছে।