‘আমার কর্মকৌশল ও সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর এবং কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক ও আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা শাহ আহমদ শফী।
রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে আলেম-ওলামাগণ কর্তৃক আয়োজিত শুকরানা মাহফিলে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এমন মন্তব্য করেন। আল্লামা শফীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মুফতি নুরুল আমীন। বক্তব্য শেষে আল্লামা শফী শুকরিয়া স্মারক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন।
শাহ আহমদ শফী বলেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। রাজনৈতিক কোনো দলের সঙ্গে আমার ও হেফাজতে ইসলামের নীতিগত সংশ্লিষ্টতা নেই। মনে রাখবেন, মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে রক্ষা করাই হেফাজতে ইসলামের মূল লক্ষ্য। হেফাজতে ইসলামের নীতি ও আদর্শের ওপর আমরা অটল-অবিচল আছি। আমার কর্মকৌশল সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার সুযোগ নেই। আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে অপব্যাখ্যা, মিথ্যাচার করার অবকাশ নেই।’
তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নানা ফিৎনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মুসলমানদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভেদ বাড়ছে। আমাকে ও হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলক প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যাচার চালাচ্ছে। কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্যক্তি বিশেষের কথায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান সঙ্কটকালে আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের শিশাঢালা প্রচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকা সময়ের দাবি।’
হেফাজতে ইসলামের আমীর বলেন, ‘আমি জীবনের শেষ প্রান্তে পা রেখেছি, বিভিন্ন রোগ-শোক, ব্যাধি-বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা সত্ত্বেও আল্লাহর দরবারে শুকর গুজার করছি, ইসলাম ও মুসল্লিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য জীবনের শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে দ্বীনের খেদমত করে যাওয়াই হচ্ছে আমার একমাত্র তামান্না। আপনারা অবগত আছেন যে, কওমি সনদ স্বীকৃতির ঐতিহাসিক দাবিটি দীর্ঘদিনের। অতীতে এই দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের ওলামা-কেরাম বহু আন্দোলন করেছেন। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বারবার, কিন্তু এই স্বীকৃতির ন্যায্য দাবিটি পূরণ হয়নি। সম্প্রতি বেফাকসহ অন্যান্য বোর্ড সমূহের যৌথ উদ্যোগ ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে বর্তমান সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বীকৃতির দাবিটি ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১১ এপ্রিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী দাওরায় হাদিসকে মাস্টার্সের সমমর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দেন। ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাস্টার্সের ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবির সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কওমি মাদরাসার ঐতিহ্য-স্বতন্ত্র-স্বকীয়তা বৈশিষ্ট্য ও দারুল উলুম দেওবন্দের চিন্তা-চেতনা এবং মূলনীতিকে শতভাগ অক্ষুণ্ন রেখে আইনের খসড়া ১৩ আগস্ট মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়।’
কওমি মাদরাসার ইতিহাস তুলে ধরে শফী বলেন, ‘১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত উপমহাদেশের ওলামা-কেরাম ও মুসলমানদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে আসে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয়। এটা ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সারা দুনিয়ার সর্বমহলে সমাদৃত ও পরিচিত নাম। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামের বহুমুখী খেদমত দিয়ে আসছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাত থেকে এই উপমহাদেশ মুক্ত হওয়ার পেছনে দেওবন্দের অবদান অবিস্মরণীয়।’
তিনি বলেন, ‘দেশ, জাতি ও ধর্মের কল্যাণে কওমী ওলামা-কেরামদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। তাদের মনের ভাষা, আবেগ, চিন্তা-চেতনা, অনুধাবন ন্যায্য দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে শত আপত্তি ও বাধা উপেক্ষা করে কওমি সনদের বিল পাস করে শেখ হাসিনা আন্তরিকতা ও সাহসিকতার সহিত সেই ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে তার কওমি ওলামা-কেরামদের প্রতি দরদপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আন্তরিক শুকরিয়া করছি, মোবারকবাদ জানাচ্ছি। কেননা, মানুষের শুকরিয়া আদায় করা নৈতিক ও দ্বীনই কর্তব্য।’
কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, ‘কওমি মাদরাসা জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সূচণালগ্ন থেকে সরকারী প্রভাব মুক্ত থেকে আল্লাহ-তায়ালার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে দল-মত নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ আমল থেকে বৈরী পরিবেশ ও হাজারও ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আলেম সমাজ কোরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা বিকশিত করে আসছে। কওমি মাদরাসা মূলত জনগণের প্রতিষ্ঠান। জনগণ আতঙ্কিত হয়, জনমত বিভ্রান্ত হয় এমন কোনো কাজ সংগত কারণে কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্রগণ করে না, করতে পারে না। জনগণের নৈতিক ও আত্মিক সাধন তাদের অন্যতম দায়িত্ব।’
কওমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের সামাজিক অবস্থান সুদৃঢ় ও উজ্জ্বল হয়েছে। দ্বীনই খেদমতের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজেদের মেধা ও প্রতিভা কাজে লাগিয়ে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করায় সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শফী বলেন, ‘ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। আপনার শাসনামলেও লাখ লাখ কওমি-কেরামের সনদের স্বীকৃতির দ্বারা ধন্য হয়েছে। আপনার এ অসামান্য অবদান ইতিহাসের সোনালি পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আল্লাহ, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)ও সাহাবা-কেরামদের বিরুদ্ধে অবমাননা বন্ধ, নবীজীর মহান বৈশিষ্ট্য খতমে নবুয়াতের আকীদা বিশ্বাস পরিপন্থী অপপ্রচার রোধ এবং দ্বীনের দাওয়াতের সঠিক কাজ ওলামা-কেরামদের মাধ্যমে ব্যবস্থা করুন।’
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ওলামা-কেরামদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আপনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।’