#

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলিতে শিক্ষার্থীরা সাধারণত কেমন করে দাঁড়ায়? কোথাও ক্লাস অনুযায়ী, কোথাও প্রতিষ্ঠানে কোনো নামে হাউস থাকলে সেই অনুযায়ী দাঁড়ানোর রীতি আছে। কিন্তু রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী দাঁড়ানোর ঘটনা বোধ হয় একেবারেই নতুন।

আজ মঙ্গলবার রংপুরের তারাগঞ্জের ও/এ ডিগ্রি কলেজে মাঠে উপজেলার ১৬৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়েছিল রক্তের ৮টি গ্রুপ ধরে। নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি মাসে ওরা অন্তত একবার এভাবেই দাঁড়ায়। আজ ছিল বিশেষ দিন। ১০ মাস ধরে উপজেলার ২২ হাজার শিক্ষার্থীসহ ৭০ হাজার মানুষের রক্তের গ্রুপ করা হয়েছে। আজ রক্তের গ্রুপের কার্ড তুলে দেওয়া হলো। সেই সঙ্গে গ্রুপভিত্তিক ক্লাবেরও উদ্বোধন হলো। উদ্বোধন করেন রংপুরের জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব। বললেন, ‘এ কাজ সারা দেশে অনন্য নজির হয়ে থাকবে।’

তারাগঞ্জের এই ‘অনন্য’ ঘটনার রূপকার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিলুফা সুলতানা।
ইউএনও হিসেবে তারাগঞ্জেই প্রথম দায়িত্ব পেয়েছেন জিলুফা। আজ রক্তের গ্রুপের নির্ণয়ের অভিনব কাজই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর উপজেলাবাসীকে নিয়ে এক ঘণ্টায় আড়াই লাখ গাছের চারা রোপণ করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। তাঁর নেতৃত্বে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় সহযোগিতায় উপজেলার ১৫৩টি রাস্তায় এই গাছ লাগানো হয়। পরে ইউএনও জিলুফা এবং তারাগঞ্জবাসীকে অভিনন্দন জানায় খোদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর জিলুফা সুলতানার হাতে অভিনন্দনপত্র ও ক্রেস্ট তুলে দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।

রংপুরে তারাগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিলুফা সুলতানা। ছবি: মঈনুল ইসলাম

রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তা কেন হলো? এ প্রশ্নের জবাবে জিলুফা বললেন, ‘শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই নিজেদের রক্তের গ্রুপ জানানোটা উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি ওরা জানুক নিজ গ্রুপের আর কে কে আছে। তাহলে ওরা নিজেদের অনিরাপদ ভাববে না। জানবে নিশ্চয়ই ওদের পাশে কেউ আছে। এই ভাবনাটা তৈরিই আমার মূল উদ্দেশ্য।’  গ্রুপ নির্ণয়ের এই কাজ শুরু হয় গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে। স্কুল পর্যায়ে শুরু হয় ১ ফেব্রুয়ারিতে উপজেলার মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর শিক্ষার্থীসহ ৭০ হাজার মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় হয়। আজ সেই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১৬৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৮ জন করে শিক্ষার্থী আনা হয়। এরপর শিক্ষার্থীদের রক্তের গ্রুপ অনুযায়ী ওই কলেজ মাঠে বেলা ১১টায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় ফিতা কেটে বেলুন উড়িয়ে রক্তের গ্রুপভিত্তিক ক্লাবের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক। উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে সেখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় জেলা প্রশাসক ছাড়াও বক্তব্য দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান, ইউএনও জিলুফা সুলতানা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিয়ার রহমান।
আজকের সভায় জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব বলেন, ইউএনও জিলুফা সুলতানার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এটি একটি ভালো এবং ব্যতিক্রমী কাজ।

ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের রক্তের গ্রুপ জানা জরুরি। রক্তের গ্রুপ জানা থাকলে খুব সহজে রক্ত আদান-প্রদান করা যায়। এখন আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী রক্তের গ্রুপ জানে।’ কথা হয় কলেজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ইকরচালী ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী খাদিজা খাতুনের সঙ্গে। সে বলে, ‘এখন আমি নিজের রক্তের গ্রুপ জানি। বন্ধুদের রক্তের গ্রুপের চিনি। কারও রক্তের প্রয়োজন হলে রক্ত দিয়ে সহায়তা করব।’

‘রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি, রক্ত দানে জীবন পাব’, ‘নিজের রক্তের গ্রুপ জানি, রক্ত দিয়ে কাছে টানি’, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের এই কর্মযজ্ঞে শিক্ষার্থীসহ সবাইকে প্রেরণা জুগিয়েছে এমন স্লোগান। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাতে শামিল হয়েছেন দৌলতপুর গ্রামের আজিজুল ইসলামের মতো ঝালুড়ি বিক্রেতাও। আজ ডিগ্রি কলেজ মাঠে ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এসেছিলেন তিনি। বললেন, ‘মুই আগোত জানো নাই রক্তেরও নাম আছে। এ্যালা মুইও মোর রক্তের গ্রুপের নাম জানো। মোর রক্তের গ্রুপের সাথে যার রক্তের গ্রুপের মিল আছে তাক চার মাস পরপর রক্ত দিবারও পাইম।’

এভাবে গ্রুপ নির্ণয়ের ফল পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে। জিলুফা সুলতানা বলেন, ‘এখন স্বেচ্ছায় একজন অন্যজনকে রক্তদান দিচ্ছে। শিক্ষক, চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতায় এটা করা সম্ভব হয়েছে।’
জিলুফা সুলতানা জানান, মানুষকে প্রেরণা দিতে তাঁর এই নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবহার করা হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যদি বন্ধু হও হাত বাড়াও’ গানটি। গানটির আরও দুটি লাইন এমন ‘সবার রঙে মিশলে রং, সুরে মিললে সুর। হবে পুরোনো যত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর।’

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন