৩ মাস আগে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে টিপু হত্যার পরিকল্পনা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

ঢাকার শাহজাহানপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। ঘটনার সাড়ে তিন মাস আগে পরিকল্পনা হয় এই হত্যাকাণ্ডের। তাও আবার মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আদালত চত্বর বসে করা হয় পরিকল্পনা। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুমন শিকদার ওরফে মুসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে টিপুকে হত্যার জন্য ভাড়া করা হয় কিলার। গ্রেফতারদের বরাতে এমনটি দাবি করেছে র‌্যাব।

এরই মধ্যে শুক্রবার (১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর থেকে চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩।

তারা হলেন ঘটনার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ওমর ফারুক (৫২) ও ‘পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত’ আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) এবং মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১)।

এসময় উদ্ধার করা হয় নজরদারির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হত্যার জন্য চুক্তির ১৫ লাখ টাকার মধ্যে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী।

র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার চারজন

শনিবার (২ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যার পর র‌্যাব এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। তদন্তের একপর্যায়ে ওই চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিপু ও গ্রেফতারদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এর একপর্যায়ে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই ঢাকার গুলশানে শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যার ঘটনা ঘটে।

এদিকে টিপু হত্যার ঘটনায় গ্রেফতাররা এলাকায় মিল্কীর সহযোগী হিসেবে পরিচিত।

গ্রেফতাররা জানান, মিল্কী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে টিপুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা। এছাড়া মিল্কী হত্যা মামলার বাদীর মাধ্যমে টিপুর নাম এজাহারে দেন ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা। পরে আদালতের মাধ্যমে মামলা থেকে অব্যাহতি পান টিপু। এতে ক্ষুব্ধ হয় ওমর ফারুকের দল। পরে ২০১৬ সালে একই দ্বন্দ্বের জেরে টিপুর সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করে এই দলটি। বর্তমানে রিজভী হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

গ্রেফতাররা আরও জানান, তাদের ধারণা টিপুর কারণেই রিজভী হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়েছে। এরই মধ্যে মামলার বাদী রিজভীর বাবা আবুল কালামের সঙ্গে গ্রেফতার ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লাখ টাকায় দফারফা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টিপুর কারণে মীমাংসায় যাননি কালাম।

একপর্যায়ে কালামকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওমর ফারুকরা। কিন্তু জাহিদুল ইসলাম টিপুর সঙ্গে চলাচল করার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে তারা যখন দেখলো, কালামের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ, তখন তারা টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যাতে মামলা পরিচালনা ধীরগতি করা যায়। তাদের ধারণা ছিল, কালাম একা মামলাটি সঠিকভাবে চালাতে পারবেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় তিন মাস আগে, রিজভীর মামলার সাক্ষ্য শেষে আদালত চত্বর এলাকায় টিপু হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেন ওমর ফারুকরা।

র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, রিজভী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে তারা অর্থের বিনিময়ে সাক্ষ্য দিতে বিরত থাকতে বলেন। এতে মোরশেদুল আলম রাজি থাকলেও টিপুর চাপে সাক্ষ্য দেন।

পরে রিজভী হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেন মোরশেদুল আলম। এরপর টিপু হত্যা বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন মোরশেদুল।

হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য গত ১২ মার্চ দুবাই যান হত্যার নির্দেশদাতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা।

টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি

র‌্যাব বলছে, হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘটিত হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। ঘটনার আগে দেশ থেকে নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসার কাছে তথ্য দিতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর, নাছির আনুমানিক চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। পরে গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় টিপুকে নজরদারিতে রাখেন কাইল্লা পলাশ। সেই সঙ্গে তার অবস্থান সম্পর্কে ফ্রিডম মানিক নামে আরেকজনকে জানান। সেই তথ্য অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় কিলার।

মূলত, দুবাই বসে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন মুসা। এই হত্যার জন্য চুক্তি হয় ১৫ লাখ টাকা। এই ১৫ লাখ টাকার কে কতো দেবে তাও ভাগ করে দেন মুসা। নয় লাখ টাকা দেন ওমর ফারুক। বাকি ছয় লাখ টাকা দেন গ্রেফতার নাছির, সালেহ ও মুসা। দুবাইয়ে যাওয়ার আগে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যান মুসা। হুন্ডির মাধ্যমে আরও চার লাখ টাকা দেওয়া হয় তাকে। বাকি ছয় লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ছয় লাখের মধ্যে র‌্যাব গ্রেফতারের সময় তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় কিলার নাছিরকে ঘটনাস্থলের পাশে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট ও কেডস পরা অবস্থায় দেখা যায়। টিপুকে হত্যার পর নাছির তার মোবাইল ফ্লাশ করে বিক্রি করে দেন ও সিমকার্ড ভেঙে ফেলেন। পরে মোবাইল ও সিমকার্ড উদ্ধার করে র‌্যাব।

এছাড়া ঘটনার আগের দিন নাছির সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একদিন অবস্থান করেছিলেন। সালেহ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত।

গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শোরুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা প্রীতিও (১৯) গুলিতে নিহত হন।

চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর ওইদিন রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন।