বাবার ইচ্ছায় ডাক্তারি না পড়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়া স্টিফেন উইলিয়াম হকিংকে বলা হয় আইনস্টাইনের পর এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের কোয়ান্টাম থিওরি ব্ল্যাক হোলের মতবাদই বিজ্ঞানী হিসেবে তাকে সারাবিশ্বে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ২১ বছর বয়স থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেও প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন তিনি।
গত ৮ জানুয়ারি ছিল স্টিফেন হকিংয়ের জন্মদিন। তাই এ যুগের আইনস্টাইনকে নিয়ে আজকের আয়োজন। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাহবুবর রহমান সুমন।
স্টিফেন হকিং
১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ড শহরের ১৪ হিলসাইড রোডের ফ্রাঙ্ক হকিং ও তার স্ত্রী ইসাবেলার কোলজুড়ে জন্ম নেয় এক শিশু। ঝটপট করেই তার নাম রাখা হয় স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। সেদিনের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ছিল- ঠিক ৩০০ বছর আগে এইদিনে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকারী গালিলিও গ্যালিলি। সেদিন জন্ম নেয়া এই শিশুই আজকের স্টিফেন হকিং। বিশিষ্ট ইংরেজ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ হিসেবে বিশ্বের সর্বত্র পরিচিত নাম। তাকে বিশ্বের সমকালীন তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পরিবার
হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং ছিলেন একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসাবেলা হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তারা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এছাড়া হকিং পরিবারে অ্যাডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও রয়েছে।
ছেলেবেলা
অ্যালবা শহরে শৈশব কেটেছে স্টিফেনের। ছোটবেলা থেকে তিনি খুব দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করাটা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তার। আর সব বাচ্চার মতো হকিং রেডিও খুলে তার ভেতরটা দেখতেন খেলার জন্য। এছাড়া হকিং উচ্চাঙ্গ সংগীত পছন্দ করতেন।
পড়াশোনা
বাচাল ও দুষ্টু ছেলেটির বাবার ইচ্ছে ছিল স্টিফেনকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু তিনি যখন ঘোষণা করলেন, তিনি পড়তে চান গণিত; তখন ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হলেন ফ্রাঙ্ক। তার ধারণা ছিল, ওসব পড়লে স্টিফেনকে আজীবন বেকার থাকতে হবে।
সে সময়ের নিয়ম অনুসারে, ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং সেন্ট অ্যালবার মেয়েদের স্কুলে পড়েন। পরে সেখান থেকে ছেলেদের স্কুলে চলে যান। স্কুলে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বটে তবে অসাধারণ ছিল না। বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। কিন্তু হকিং গণিত পড়ার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সেজন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করেন। সে সময়ে তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। শেষ পরীক্ষায় ভাইবা বোর্ডে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, ‘আমি যদি প্রথম শ্রেণি পাই, তাহলে ক্যামব্রিজে চলে যাব। তা না হলে এখানেই থাকব।
কর্মজীবন
হকিং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি কেমব্রিজের গনভিলি এবং কেয়াস কলেজের ফেলো হিসাবে কর্মরত আছেন। শারীরিকভাবে ভীষণরকম অচল এবং এএলএসের জন্য ক্রমাগত সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হওয়া সত্ত্বেও বহু বছর যাবৎ তিনি তার গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়, নাম থিওরি অব এভরিথিং।
মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস
১৯৬২ সালে পিএইচ.ডির ছাত্র থাকাকালে হকিং এএলএসের অসুখের কথা প্রথম জানতে পারেন। ক্যামব্রিজে পিএইচ.ডি কোর্স করাকালে হকিং মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ছুটিতে বাড়িতে আসার পর ডাক্তার পিতা তাকে নিয়ে ছুটলেন বিভিন্ন চিকিৎসালয়ে। জানা গেল, হকিং আক্রান্ত হয়েছেন মটর নিউরন ডিজিজে। আমেরিকায় এই রোগটির নাম লো গ্রেইরিজ ডিজিজ। স্নায়ুতন্ত্রের এই রোগ ক্রমশ হকিংয়ের প্রাণশক্তি নিংড়ে নেবে। চিকিৎসকের ভাষ্যমতে, হকিং আর মাত্র দু-আড়াই বছর বাঁচবেন। তবে অবাক করা ব্যাপার হল, সেই হকিং প্রায় পাঁচ দশক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
১৯৮৫ সালে আবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন হকিং। ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভার CERN এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসকরাও তার কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সম্প্রতি হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি তথ্যচিত্র। সেখানেই এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারিনি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, হাল ছাড়েননি।’
অনন্য ভালোবাসা
জেন ওয়াইল্ডের এক অনন্য ভলোবাসার নাম। কেননা স্টিফেন হকিংয়ের আয়ু দুই বছর জেনেও বিয়ের আসরে বসেছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে হকিংয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের দিন শ’খানেক আমন্ত্রিত অতিথির অনেকেই জানতেন এই অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল হাসিখুশি চেহারার, সোনালি ফ্রেমের চশমা পরিহিত যুবকের আয়ু আর মাত্র দু’বছর। শুধু আমন্ত্রিতরা নন, এই নির্মম সত্যটি জানা ছিল ওই দিনের বর স্টিফেন হকিং ও কনে জেন ওয়াইল্ডের।
বিবাহ
বিয়ের দিনের অ্যালবামে দেখা য়ায়, লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো স্টিফেনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাজনম্র বধূটির মুখে হাসি। হ্যাঁ, বিয়ের আসরে হকিংয়ের হাতে লাঠি ছিল। ৬২ সালের এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী জেনের সঙ্গে লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট হওয়ার আগেই হকিংয়ের অসুস্থতা ধরা পড়ে। কাজেই উজ্জ্বল স্ফূর্তিবাজ, প্রাণবন্ত হকিংকে জেন দেখেননি কখনো। জেনের ভালোবাসা তাই অসুস্থ হকিংকে ঘিরেই। হকিং তার এক ব্ক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বিয়ের কারণে আমি বেঁচে থাকতে, এগিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। জেন আসলেই আমার বেঁচে থাকার প্রথম প্রেরণা।
হকিংয়ের অবদান
পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দু’টি অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরাজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্ব ব্ল্যাক হোল-এর ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকিরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে অভিহিত। এছাড়া প্রায় ৪০ বছর ধরে হকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করছেন। লিখিত বই এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থেকে হকিং একাডেমিক জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। তিনি রয়েল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য।
অন্যদিকে তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ষাটের দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের উপর ভিত্তি করে সত্তরের দশকে হকিং প্রথম তাদের তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে ভাবা হতো- এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকোনো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে। এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন সময় হকিং নানা বিষয় নিয়ে মন্তব্য প্রদান করেন।
পুরস্কার
হকিংয়ের উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হল- ১৯৭৫ সালের এডিংটন পদক, ১৯৭৬ সালের হিউ পদক, ১৯৭৯ সালের আলবার্ট আইনস্টাইন পদক, ১৯৮৮ সালের উলফ পুরস্কার, ১৯৮৯ সালের প্রিন্স অফ অস্ট্রিয়ানস পুরস্কার, ১৯৯৯ সালের জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, ২০০৬ সালে কোপলি পদক ও আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদক।
পদবি
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি তাকে ইতোমধ্যে ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ এবং ‘অর্ডার অব দ্য কম্প্যানিয়ন’ অনারে ভূষিত করেন।
মূর্তি স্থাপন
২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজি কেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে।
জাদুঘর
মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরের বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রাখে।
স্টিফেন হকিং প্রতিভা দিয়ে জয় করেন বিজ্ঞান। হাজার বছর বেঁচে থাকুক বিজ্ঞানের এই নির্বাক জাদুকর।