সীমিত সম্পদ দিয়েও যে ঘনবসতিপূর্ণ একটা ছোট্ট দেশে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা যায়, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তা প্রমাণ করেছে। জাতিসংঘের দেওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন তরুণ উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে হলে তরুণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ ভূমিকাই তো এখন সময়ের দাবি।
সামাজিক উদ্যোক্তা আন্দোলন থেকে শুরু করে লাভজনক বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। একটু ভালোমতো লক্ষ করলেই দেখা যায়, এসডিজির ১৬৯টি টার্গেট অর্থনীতির সব ক্ষেত্রজুড়ে আছে। অর্থাৎ এই টার্গেট পূরণই নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
এসডিজির প্রথম লক্ষ্যটি নিয়েই যদি বলি, তাহলে দারিদ্র্য দূরীকরণের মোক্ষম উপায় হচ্ছে মানুষের আয় বৃদ্ধি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৬ লাখ তরুণ বেকারত্বের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন, সেখানে প্রথম লক্ষ্য পূরণই কি বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ নয়? উত্তরটি হচ্ছে ‘না’। কারণ, অতি ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে রাষ্ট্রের পক্ষে সবার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এই সত্য আমাদের মেনে নিতে হবে। এমন একটি নিরেট বাস্তবতার প্রেক্ষাপট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরির প্রয়োজন এবং সম্ভাবনা দেখিয়ে দিচ্ছে—যা আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। সমস্যার এত সুন্দর সমাধান এখন আগামী দিনের জন্য আমাদের কাছে সুযোগ, যদি আমরা তা গ্রহণ করি। মানুষের আয় বৃদ্ধি হলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবেই। তাই উদ্যোক্তাদের এখন অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে হবে।
অন্যদিকে আমি যদি লক্ষ্য ৫ অর্থাৎ, লিঙ্গ সমতা নিয়ে কথা বলি, তাহলে এখানেও উদ্যোক্তার ভূমিকা চলে আসে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রবেশাধিকার বৃদ্ধিকল্পে উদ্যোগী নারীদের জন্য সরকারি-বেসরকারি নানা সেবা-সুবিধা এবং প্রশিক্ষণ প্রকল্প সমাজে জানান দিচ্ছে যে নারীশক্তিকে এখন শুধুই সহায়ক ভূমিকায় না থেকে সামনে এসে নেতৃত্ব দিয়ে লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে হবে।
লক্ষ্য ৯-এ বলা আছে শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা। এ উন্নয়ন কাদের হাত ধরে হবে? এ দায়িত্বের ভার নেওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য তো তরুণেরাই। একজন উদ্যোক্তা তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন উপায়ের জানান দেন, যা সমাজকে একটি ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাহলে এই যে শিল্প বা কৃষি খাত কিংবা রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন—এই প্রতিটার জন্যই এমন মানসিকতার মানুষ লাগবে, যাঁরা উদ্যোগী।
১০ নম্বর লক্ষ্যে বলা আছে, বৈষম্য কমানোর কথা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক মুক্তি বৈষম্যের হারের সমানুপাতিক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যদি আমরা সফল উদ্যোক্তা তৈরির পথকে মসৃণ করে দিই, তাহলে কি বৈষম্য টেকসই উন্নয়নকে আর বাধাপ্রাপ্ত করতে পারবে কি না? উত্তরটি হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে বাধা প্রদান অসম্ভব।
১৪ ও ১৫ নম্বর লক্ষ্য জল ও স্থলে জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করার কথা বলে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এ ক্ষেত্র দুটি সম্ভাবনার পথকে আরও বেশি প্রশস্ত করেছে। ভূমির ওপর কিংবা জলে নিচে, উভয় জায়গাতেই আমরা টেকসই উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে আছি। বিশেষ করে জল সম্পদ নিয়ে আমরা সর্বমহল থেকে সচেতনতার পথে পা বাড়িয়েছি বেশি দিন হয়নি। উদ্যোক্তারা এখানে ব্যবসা করার ভালো সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। একদিকে মুনাফা অপর দিকে টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখার সম্ভাবনা আছে এ খাতে।
জলবায়ু রক্ষায় ভূমিকা রাখা বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যেহেতু এসডিজির একটি লক্ষ্য জলবায়ুকেন্দ্রিক, সেহেতু জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে নতুন ভাবনা এবং তার বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ যে পরিমাণ তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান, পৃথিবীর বেশির ভাগ উন্নত রাষ্ট্র তা পায়নি। এ দিকটি বিবেচনায়ও বাংলাদেশ তার লক্ষ্য পূরণে উদ্যোগী তরুণদের নেতৃত্বে পৃথিবীতে নিজের অবস্থানকে নব আলোয় উদ্ভাসিত করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি ও এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সেন্টার এবং সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশ্নোত্তর
নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় কোন কোন প্রতিষ্ঠান?
নুসরাত জাহান, তৃতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ, ইডেন কলেজ, ঢাকা
বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঋণ দিচ্ছে। যেমন এসএমই ফাউন্ডেশন, জয়িতা ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে ২০০ কোটি টাকার তহবিল। জয়িতা ফাউন্ডেশন ঋণসুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এ ছাড়া সব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বছরে অন্তত একজন নারী উদ্যোক্তাকে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।
যন্ত্রকৌশল বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে কি উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব?
মারুফ হাসান, নবম শ্রেণি, রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলজ।
প্রথমত, আপনি যে খাতে কাজ করছেন, সে খাতের সমসাময়িক সমস্যা চিহ্নিত করুন এবং সেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করুন। দ্বিতীয়ত, আপনার ভালো, খারাপ কিংবা আপনার সফলতা, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন এবং এগিয়ে যান। যন্ত্রকৌশলে পড়ে উদ্যোক্তা হতে চাইলে আপনি যা করতে পারেন: নিজের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান বা কারখানা চালু করতে পারেন, প্রকৌশলী এবং গ্রাহকদের মধ্যস্থতাকারীর কাজ করতে পারেন। আরও নানা সুযোগ আছে। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। বর্তমান সরকার কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে উদ্যোক্তা ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কারিগরি শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়।
ব্যবসা করতে চাইলে শুধু আইডিয়া দিয়ে কি সফলতা সম্ভব?
রাবেয়া খাতুন, দ্বিতীয় বর্ষ, দর্শন বিভাগ, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর
একটি ভালো আইডিয়া পারে আপনার জীবনকে বদলে দিতে। সে জন্য চাই অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য যা আপনার আইডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেবে। তবে অবশ্যই শুধু আইডিয়া দিয়ে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। এটি বন্ধুর পথকে কিছুটা মসৃণ করবে কিন্তু সেই পথ চলতে হলে আরও অনেক কিছুর সংমিশ্রণ লাগবে। নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। কাজের প্রতি একাগ্রতা, আবেগ থাকতে হবে। ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুনরায় সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। সর্বোপরি, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের ভিতকে কখনো দুর্বল করা যাবে না, তবেই সফলতা হাতছানি দেবে।