প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবানদের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই দেশ থেকে চিরতরে দারিদ্র্য দূর করতে পারে।
তিনি বলেন, ‘শুধু নিজে ভালো থাকব, সুন্দর ও আরাম আয়েশে থাকব- আর আমার দেশের মানুষ, এলাকার মানুষ কষ্টে থাকবে, এটা তো মানবতা না, এটা তো হয় না। কাজেই সবাই মিলে চেষ্টা করলে দেশে আর কোনো দরিদ্র থাকবে না।’
শনিবার সকালে ‘মুজিববর্ষে গৃহহীন মানুষকে সরকারের সচিবগণের গৃহ উপহার’ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অনুষ্ঠিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন তিনি।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ খুব সাহসী। তাদের নিয়ে যুদ্ধ করেই জাতির পিতা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। কাজেই বিজয়ী জাতি হিসেবেই বিশ্বে আমরা মাথা উঁচু করে চলব।’
সে সময় বিশ্বে অন্যতম শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর গর্বিত আচরণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘তারা খুব গর্ব করত, তাদের আবার কে হারাবে, কিন্তু বাঙালিরা তাদের হারিয়ে যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পেশাজীবী বলেন বা ব্যবসায়ী বলেন বা যে যেখানেই আছেন প্রত্যেকের কাছেই আমার অনুরোধ থাকবে, যে যে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং যে গ্রামে জন্মেছেন তার উন্নয়নে যেন সহযোগিতা করেন।’
করোনার মধ্যে তার সরকারের গ্রামপর্যায় পর্যন্ত সাহায্য পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান আরও বলেন, ‘যারা বিত্তশালী তারা নিজ নিজ এলাকায় প্রত্যেকেই যেন দুস্থদের দিকে যেন ফিরে তাকান। গৃহহীনকে ঘর করে দেন বা তাদের কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করে দেন।’
তিনি সচিবদের এই গৃহহীন প্রকল্প গ্রহণকে একটি মহৎ উদ্যোগ আখ্যায়িত করে এ জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তাভাবনা থেকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আজ যে মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন। একটা ঘর করে দিয়েছেন, একটা মহৎ কাজ আপনারা করেছেন।’
‘আমি মনে করি, ভবিষ্যতে মানুষজন আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এবং মানুষের পাশে দাঁড়াবে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নতসমৃদ্ধ হয়ে গড়ে উঠবে। জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা পূরণ করব,’ যোগ করেন তিনি।
মুজিববর্ষে দেশের সব গৃহহীনকে ঘর করে দেয়ার সরকারের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সচিবদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৮০ জন সচিব নিজ নিজ এলাকায় ১৬০টি গৃহনির্মাণ করে গৃহহীনদের দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সাল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী এবং এই মুজিববর্ষে (২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ) আমাদের ঘোষণা বাংলাদেশে আর একটি মানুষও গৃহহীণ থাকবে না, ভূমিহীন থাকবে না।
তিনি বলেন, তার সরকারের এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও আজ নিজ নিজ এলাকার দরিদ্র-অসহায় মানুষকে ঘর তৈরি করে দেয়ার মাধ্যমে সচিবরাও সরকারি এ উদ্যোগে শরিক হয়েছেন এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ এলাকায় দুটি করে ঘর করে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই আজ এই ঘর দেয়ার পর দুঃখী মানুষের মনে যে আনন্দ আসবে, আমি মনে করি এটাই সব থেকে বড় পাওয়া।’
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজন্ম সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিজীবনে অনেক কিছু করতে পারতেন। তারপরও দুঃখী মানুষের কথা ভেবেই তিনি সে পথ বেছে নেননি।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তিনি (জাতির পিতা) ছোটবেলা থেকেই নিজ চোখে দেখেছেন। যে কারণে তার সবসময় একটা উদ্যোগই ছিল- মানুষের জন্য কিছু করার।’
তিনি বলেন, ‘বাংলার নিপীড়িত, বঞ্চিত জনগণের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা ও দারিদ্র্যের কষাঘাত দেখে জাতির পিতার প্রাণ কেঁদে উঠত। যে কারণে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এদেশের মানুষের জন্য কিছু একটা করে যাবেন। সেটা করতে গেলে এদেশ স্বাধীন করতে এবং এ দেশের মানুষকে একটা সুন্দর জীবন দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা নিজের জীবন উৎসর্গ করে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনিই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে আত্মপরিচয়ের সুযোগ করে দিয়ে গেছেন।’
জাতির পিতার নীতি ও মহান আদর্শের উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা আদর্শের সাথে আপস করেননি বা পিছপা হননি, সবসময় ন্যায্য কথা বলেছেন, ন্যায্যভাবে চলেছেন এবং এদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পর জনগণকে উন্নত-সুন্দর জীবন দেয়াই বঙ্গবন্ধুর অন্যতম লক্ষ্য এবং স্বপ্ন ছিল উল্লেখ করে তার একটি ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নতজীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা এ প্রসঙ্গে পিতা হিসেবে সবসময় দেশের কাজে ব্যস্ত থাকায় তাকে কাছে না পাওয়া এবং দেশ স্বাধীনের ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া জাতির পিতার বিখ্যাত সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘জাতির পিতা বাংলার মানুষকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন। এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরই ভালোবাসা পেয়েছেন।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালে গৃহহীনকে ঘরবাড়ি করে দেয়া এবং ভূমিহীনকে খাসজমি প্রদানে জাতির পিতার ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্পের উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) নিজে নোয়াখালী যান (এখন লক্ষ্মীপুর তখন সেটা মহকুমা ছিল) এবং সেখানেই গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ভিত্তি রচনা করেন। তার কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ওপরই এই দায়িত্ব ছিল এবং তিনি সেখানে ঘর তৈরি করে দিয়ে আসেন।’
বর্তমান সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলাও জাতির ‘পিতার চিন্তার ফসল’, উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রতিটি ইউনিয়নে তিনি ১০ শয্যার হাসপাতাল করে দেয়ার উদ্যোগ নেন। তার চিন্তা ছিল চিকিৎসাসেবাকে মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেবেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সে সময়ই প্রাথমিক শিক্ষা এবং মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করেন এবং সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগও নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রত্যেকটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করে জেলা গভর্নর নিযুক্ত করে দেন।’
অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে জাতির পিতার দেয়া ভাষণ সম্প্রচারের উল্লেখ করে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রাপ্তির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণের জন্য জন্য কিছু করার জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।
’৭৫ এ জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের অবৈধ ক্ষমতা দখল এবং দেশে সেনাশাসনের সূচনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর আবারও দেশের দুঃখী মানুষ দুঃখীই থেকে গেছেন। তাদের প্রতি কেউ ফিরেও তাকায়নি। কেননা পরবর্তী সরকারগুলো ক্ষমতাকে ভোগের বস্তু এবং নিজেদের আগের গোছাবার জন্য ব্যবহার করেছে।’
তিনি বলেন, বারবার অবৈধভাবে সরকারে আসা জনগোষ্ঠীর সাথে দেশের একটি সুবিধাবাদী শ্রেণি হাত মিলিয়ে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করলেও দেশের আপামর জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর বিদেশে রিফিউজি হিসেবে থাকতে বাধ্য হয়ে ’৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে তিনি জোর করে দেশে ফিরে আসেন এবং সে সময় তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে কেবল হাড্ডি-কঙ্কালসার মানুষ দেখেছেন। তিনি সরকারের গেলে তাদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করবেন, তখনই শপথ নেন।
জাতির পিতার ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্পের অনুকরণে তার সরকারের ‘আশ্রয়ন’ এবং ‘ঘরে ফেরা’ এবং ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকার বস্তিবাসী যদি নিজ গ্রামে ফিরে যায় তাহলে তাদের সরকারের টাকায় ঘর করে দেয়া, খাবারের ব্যবস্থা এবং টাকা-পয়সা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারণ প্রত্যেকে যেন নিজে কিছু করে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারেন, কারও কাছে যেন হাত পাততে না হয়।’
‘গ্রামীণ জনগণকে আর্থিক সচ্ছলতা এনে দেয়া’ তার দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ জন্য ব্যাপকভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণসহ প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি এবং মুজিববর্ষে দেশের প্রত্যেকটি ঘর যেন আলোকিত হয় সে ব্যবস্থা নিয়েছি।’
তিনি এ সময় আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের উদ্যোগ এবং সারাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তার সরকারের উদ্যোগগুলোর উল্লেখ করে দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, ‘যদিও করোনাভাইরাসের কারণে অনেক কাজ থমকে গেছে কিন্তু আমরা বসে নেই। এই করোনাভাইরাসের মধ্যেও গ্রামপর্যায় পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছি।’
তিনি তার সরকার নির্বাচনে ভোট প্রদান করায় জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আমাদের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছে। তারপর থেকে জনগণের সেবা করে আমরা অন্তত এটুকু বলতে পারি বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলতে পারে- সে সম্মানটা আমরা অর্জন করেছি।’