নিজের গর্ভের সন্তানকে ফিরে পেতে মামলা করেন মা। বিচারিক আদালতে ব্যর্থ হয়ে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন তিনি। কিন্তু হাইকোর্টের সিদ্ধান্তেও নিজ সন্তানকে ফিরে পেলেন না। সন্তানকে আপন ছোট বোনের জিম্মায় রাখা এবং মাঝেমধ্যে মা গিয়ে সন্তানকে দেখতে পারবেন বলে আদেশ দেন আদালত।
সোমবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে মামলাটির শুনানির সময় মানুষের জটলা আর ভিড় দেখে শিশু অংশুমান কেঁদে ফেলে। মমতাময়ী বিচারপতি এ সময় তাকে কোলে নিয়ে আদর করে মুখে তুলে দেন ললিপপ।
পরে শিশুর মা এবং খালার পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে খালার হেফাজতে থাকা শিশু অংশুমানকে খালা শোভা রানী গুহের কাছে থাকার আদেশ দেন। এ সময় শিশুটির মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, আমি আমার সন্তানকে কারও কাছে দত্তক দেইনি। আদালতের আদেশ আমি মানি না। সরকার আমাকে গুলি করে মারুক।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, আজ শিশু অংশুমানের খালা শোভা রানী গুহ ও স্বামী বিপ্লব গুহকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় শিশুটির মা জেবা দে, বাবা বিপুল দেসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত ১৮ মাসের শিশু আপাতত খালার হেফাজতে রাখার আদেশ দেন। তবে গর্ভধারিণী মা মাঝেমধ্যে সন্তানকে দেখার সুযোগ পাবেন।
টাঙ্গাইলের আলোচিত শিশু অংশুমানকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক খালার হেফাজতে দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মায়ের করা রিট নিষ্পত্তি করে এ আদেশ দেন হাইকোর্ট।
আদালতে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলেও জানান আদালত। একই সঙ্গে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তলব করা টাঙ্গাইল-ক অঞ্চলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সতর্ক করে অব্যাহতি দেন আদলত। হাইকোর্টের তলবের পরিপ্রেক্ষিতে আজ ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত হন।
হাইকোর্টের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আজ এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম, তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট নাহিদ ফারজানা, আলো মন্ডল ও স্নিগ্ধা সরকার। অন্যদিকে, খালার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সুব্রত সাহা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে আইনজীবী অজি উল্লাহ আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
পরে আইনজীবী শ ম রেজাউল করিম জানান, আদালতের আদেশ অনুযায়ী এখন শিশু অংশুমান আপাতত খালার হেফাজতে থাকবে। মা শিশুটিকে দেখাশোনার সুযোগ পাবেন। মামলাটি এখন উপযুক্ত এখতিয়ার সম্পন্ন দেওয়ানী আদালতে যাবে। দেওয়ানী আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের ভিত্তিতে দত্তক বিষয়ে এ মামলায় রায় দেবেন।
অংশুমানকে খালার হেফাজতে দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন শিশুটির মা। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ এপ্রিল ১৮ মাসের শিশু অংশুমানকে খালার হেফাজতে দেয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে তলব করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে, খালার হেফাজতে থাকা শিশু অংশুমান, তার খালা শোভা রানী গুহ ও স্বামী বিপ্লব গুহকে আদালতে হাজির করতে ঘাটাইল থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়া হয়।
আদালতে শুনানির সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আদালত শিশুটিকে খালার হেফাজতে দেয়ার পর মা কোলে নিতে চান। তখন মা শিশুটিকে কোলে নেন। শিশুটি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দার নিজেই শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। পরে তিনি খালার হেফাজতে দেন। এরপর খালা শিশু অংশুমানকে নিয়ে চলে যান।
হাইকোর্টে করা মায়ের আবেদনে উল্লেখ করা হয়, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার চান্দশী গ্রামের বিপুল দে ও জেবা রানী দম্পতির একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় অংশুমান দে। শিশুটির বয়স যখন এক বছর তখন তার খালা-খালু তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর শিশুটির খালা ও খালু নিঃসন্তান দম্পতি হওয়ায় দু-তিন দিনের জন্য শিশু অংশুমানকে নিয়ে যায়। এরপর ওই শিশুর বাবা-মা তাদের সন্তান ফেরত চাইলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং শিশুটিকে বাড়িতে আটকে রাখে।
এ অবস্থায় নিজ সন্তানকে ফেরত পেতে গত ১৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইল ক-অঞ্চলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আবেদন করেন শিশুটির বাবা-মা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঘাটাইল থানার ওসিকে শিশুটিসহ খালাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
আদালতের নির্দেশে ১৮ জানুয়ারি শিশুটিকে হাজির করা হলে তাকে তার মায়ের কাছে ফেরত দেন আদালত। আবার ২১ মার্চ উভয় পক্ষের শুনানি শেষে শিশুটিকে তার খালার হেফাজতে দেয়ার আদেশ দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে শিশুটির বাবা-মা হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
তবে শিশু অংশুমানের নানী রত্না রানী চন্দ্র সাংবাদিকদের জানান, গর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুটিকে দত্তক দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মা জেবা রানী। সে অনুযায়ী শিশুটি জন্মের সময় সিজারের খরচ তার খালা বহন করেন। সেই থেকে শিশুটি তার খালার হেফাজতে আছে।