একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করেছেন। নিন্দুকেরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরেই ঘর ছেড়েছেন উরজিত প্যাটেল। অন্যদিকে দেশের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে লেজেগোবরে অবস্থায় দল। ভোট গণনার পর দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতায় থাকা তিনটি রাজ্যই হারিয়েছে বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হয়তো ভেবেছিলেন, ভোটের জোয়ারে ভাসিয়ে দেবেন সব বিতর্ক। কিন্তু হলো না। এবার মোদির আমও গেল, ছালাও গেল!
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কারণেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ভারতের এই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মতে, এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নাকি ‘সেমিফাইনাল’। লোকসভা নির্বাচনের ‘ফাইনাল ম্যাচে’ ঠিক হবে, কে করবে দিল্লি শাসন। রাজনীতির খেলায় কেউ হারে, কেউ জেতে, কিন্তু টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে না। তবে সেমিফাইনালে জিতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ফাইনালে এগিয়ে যায় জয়ী পক্ষ। নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল দেখে আপাতভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সেমিফাইনালে হেরেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এবার মোদির (পড়ুন সঙ্গে অমিত শাহ) পিছিয়ে থেকে শুরু করার পালা, কপালের ভাঁজ আর কমার নয়।
নির্বাচন হওয়া পাঁচটি রাজ্য হলো—মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানকে ধরা হয় ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোবলয় বা হিন্দি হার্টল্যান্ডের তিনটি রাজ্য হিসেবে। ফলে এর গুরুত্ব অন্য রকম। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই তিনটি রাজ্যেই কংগ্রেসকে গো-হারা হারিয়েছিল বিজেপি। গঠন করেছিল রাজ্য সরকার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এর ফল পেয়েছিল হাতেনাতে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট। পাঁচ বছর পর এসে সেই তিন রাজ্যে সরকার গঠনের ‘গেরুয়া’ স্বপ্নে কালি লেপে দিল কংগ্রেস ও বিজেপিবিরোধীরা। তবে কি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই মোদির শাসনের যবনিকা হচ্ছে! ভারতের রাজনীতি এখন এই প্রশ্নেই উত্তপ্ত।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, তিনটি রাজ্যে বেশ ভালো অবস্থানে আছে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও শেষ হাসি রাহুল গান্ধীই হাসবেন, এটা পরিষ্কার। হিন্দুস্তান টাইমসের খবর অনুযায়ী, ছত্তিশগড়ে সরকার গঠনের পথে হাঁটছে কংগ্রেস। ৯০টি আসনের মধ্যে ৬৬টি আসনে এগিয়ে আছে দলটি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন মোটে ৪৬টি আসন।
অন্যদিকে এনডিটিভি জানাচ্ছে, বিজেপির হাত থেকে রাজস্থানও কেড়ে নিচ্ছে কংগ্রেস। সেখানকার ১৯৯টি আসনের মধ্যে ১০২টিতে এগিয়ে আছে রাহুল গান্ধীর দল। মাত্র ৭২টি আসনে এগিয়ে মোদির বিজেপি। নির্বাচন কমিশন বলছে, ৩৯ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে কংগ্রেস। ৩৮ শতাংশেরও বেশি ভোট দখল করলেও আসনের হিসাবে ঢের পিছিয়ে বিজেপি। সরকার গঠনের জন্য মরুরাজ্যে প্রয়োজন ১০০টি আসন।
তবে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হচ্ছে মধ্যপ্রদেশে। ভারতের নির্বাচন কমিশনের হিসাব দেখাচ্ছে, ২৩০টি আসনের মধ্যে ১০৫টিতে এগিয়ে আছে বিজেপি। ১১৪টি আসনে এগিয়ে থেকে হুমকি দিচ্ছে কংগ্রেস। দলটির দরকার আর মাত্র দুটি আসন। ভোট দখলের চিত্রটি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। এখন পর্যন্ত ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। আর কংগ্রেসের দখলে আছে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যালট পেপার। স্বতন্ত্র ও অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দল এগিয়ে ১১টি আসনে। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, এই ছোট দলগুলোই শেষে হয়তো বড় সিদ্ধান্তের প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
অবশ্য তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম রাজ্যে কংগ্রেস-বিজেপি কারোরই পাত্তা নেই। তেলেঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাওয়ের দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির (টিআরএস) আশপাশে কেউ নেই। নির্বাচনের আগে টিআরএসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চেয়েছিল বিজেপি। চন্দ্রশেখর রাও তা এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ নতুন এই রাজ্যে এক অর্থে পরাজয়ের গ্লানিই সহ্য করতে হলো মোদিকে। অন্যদিকে মিজোরামে একাধিপত্য দেখাচ্ছে মিজো ন্যাশনাল ফন্ট। বিজেপি পেয়েছে মোটে ১টি আসন!
অথচ ২০১৩ সালের রেজাল্ট কার্ড বিজেপির জন্য কী সুখকরই না ছিল! মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের চেয়ে ১০০টির বেশি আসন পেয়েছিল দলটি। আর এবার ধারণা করা হচ্ছে, পঞ্চাশেরও বেশি আসন বিজেপির হাতছাড়া হচ্ছে। রাজস্থানে এই সংখ্যা যাচ্ছে নব্বইয়ের ঘরে। ছত্তিশগড়ের কথা না বলাই ভালো। সেখানে বিজেপির দুর্গ ধসিয়ে প্রাসাদ গড়েছে কংগ্রেস। অর্থাৎ ঠিক যে হারে বিজেপির আসন কমেছে, সেই হারে লাভবান হয়েছে কংগ্রেস।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হুট করেই বিপদে পড়ে গেলেন—বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই বেকায়দায় আছেন তিনি। চলতি বছরে একের পর এক ধাক্কা সইতে হচ্ছে তাঁকে। বছরের শুরুতে দলিত সম্প্রদায়ের বিক্ষোভে কেঁপে উঠেছিল বিজেপি। উচ্চবর্ণের প্রতি দলটির একচোখা পক্ষপাতিত্বের তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল পুরো দেশে। কিছু এলাকায় দল বেঁধে অনেক দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু ধর্ম ত্যাগও করেছিলেন। বিক্ষোভের সেই আগুন এখনো ধিকি ধিকি জ্বলছে।
ওই বিক্ষোভ সামলে ওঠার পর কোথায় মোদি একটু আরাম করবেন, তা না। পড়তে হলো রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে ঝঞ্ঝাটে। এই বিতর্কে কংগ্রেসের তরফ থেকে উঠেছে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ। বলা হচ্ছে, কংগ্রেসের সময়ে করা চুক্তিতে প্রতিটি যুদ্ধবিমানের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের হিসাব ছিল, তার তুলনায় প্রায় তিন গুণ অর্থ খরচ করছে মোদির সরকার! বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী, এই পুরো কেনাকাটার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টনার হিসেবে থাকছে অনিল আম্বানির রিলায়েন্স গোষ্ঠী। অথচ অনিলের সংশ্লিষ্ট সেই কোম্পানির প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই! নিন্দুকদের মন্তব্য, ব্যবসায় বিপর্যস্ত অনিল আম্বানির পকেট ভরাতেই মরিয়া মোদি।
এর মধ্যেই চলে এল সিবিআই-কাণ্ড। ভারতের অন্যতম প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) দুই শীর্ষ কর্তার ঝগড়া সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। নিজে কথা বলেও দুই শীর্ষ কর্তার পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ও মামলা-তদন্তের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো আটকানো যায়নি। শেষে রাকেশ আস্থানা ও অলোক ভার্মা—এই দুই শীর্ষ কর্তাকেই বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় সরকার। অভিযোগ উঠেছে, দলীয়করণের চূড়ান্ত প্রদর্শনী সাজিয়ে সিবিআইকে ধ্বংস করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
অভিযোগের তালিকা এখনো শেষ হয়নি। কাল তা আরও লম্বা করে দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী গভর্নর উরজিত প্যাটেল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মোদির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই মেয়াদ শেষের আগেই চাকরি ছেড়েছেন উরজিত, যা স্বাধীনতা উত্তর ভারতে নজিরবিহীন। আর এই উপমহাদেশে কোনো সরকারি পদস্থ ব্যক্তি পদত্যাগের পর কেন ‘ব্যক্তিগত কারণ’ দেখান, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই! অথচ এই উরজিত প্যাটেলই একসময় ছিলেন নরেন্দ্র মোদির ‘খাস আদমি’। নোট বাতিলের মতো হযবরল পরিস্থিতির দায় উরজিতের ওপরই চাপানো হয়েছিল, যদিও সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে মোদির নাক গলানোয় রাশ টানতে চেয়ে চলে যেতে হলো প্যাটেলকে।
সমালোচক ও বিরোধীদের দাবি, একইভাবে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও প্রতিরক্ষা খাতেও রাজনৈতিক দলাদলি ঢোকাচ্ছে মোদির সরকার। আর এই সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার অস্ত্র ছিল একটাই। তা হলো, ভোটযুদ্ধে জয়। এখন সেখানেও গ্যাঁড়াকলে নরেন্দ্র মোদি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষকদের অসন্তুষ্টিই কাল হয়েছে বিজেপির। কিছুদিন আগেই হাজার হাজার কৃষক দিল্লির পার্লামেন্ট অভিমুখে মিছিল করেছেন। বিজেপি তাদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল শুকনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু বিজেপির চেয়ে কংগ্রেসেই স্বস্তি খুঁজে পেয়েছেন কৃষকেরা। তাই ব্যালট পেপারে সিল দেওয়ার জায়গাও বদলে গেছে।
অথচ প্রচার-প্রচারণায় কোনো ফাঁক রাখেননি মোদি। এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনকে সামনে রেখে গত দুই মাসে আশিটিরও বেশি র্যালি করেছেন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। কিন্তু বৃথাই গেল সব। শুধু বক্তৃতায় কি আর চিড়ে ভেজে? সুতরাং আসছে বছরের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কংগ্রেসের জমজমাট লড়াই দেখার প্রত্যাশা করাই যায়। এই পাঁচ রাজ্যে পরাজয় ভারতের ক্ষমতার কাঠামো থেকে নরেন্দ্র মোদিকে সরিয়ে দেয় কি না, সেটিই এখন দেখার।