‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ভেবেছিলাম মা-বাবার মুখ আর দেখা হবে না। তখন নামাজ পড়তাম আর প্রার্থনায় বলতাম, হে আল্লাহ তুমি আমাদের বাবা-মায়ের বুকে ফিরিয়ে দাও। এভাবেই মৃত্যুর দুয়ারে বসে রাত-দিন কাটাতে হয়েছে। পরে ১৩ এপ্রিল ভোরে মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি মেলে। আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন। জলদস্যুরা জাহাজ ছেড়ে গেলে মৃত্যুর ভয় কাটলেও মায়ের কোলে ফেরার কোনো উপায় ছিল না। তাই মুক্তির পর শুরু হয় মা-বাবার বুকে ফেরার অপেক্ষা। আজ তাদের বুকে ফিরতে পেরে দারুণ খুশি আমি।’
বুধবার (১৫ মে) সকালে বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজের অনুভূতি এভাবেই ব্যক্ত করেন ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া ‘এমভি আব্দুল্লাহ’ জাহাজের নাবিক সিরাজগঞ্জের কামারখন্দে উপজেলার চর-নুরনগর গ্রামের নাজমুল হক হানিফ।
মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার দস্যুরা ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ জিম্মি করে। ১৪ এপ্রিল ভোররাতে জাহাজটি জলদস্যু মুক্ত হয়। গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করে এমভি আবদুল্লাহ। মঙ্গলবার বিকেলে জাহাজটির নাবিকরা চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে এসে পৌঁছান ‘এমভি জাহানমনি’ নামের অপর একটি জাহাজের মাধ্যমে।
বুধবার চর-নুরনগর গ্রামের আবু সামা ও নার্গিস খাতুন দম্পতির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নাবিক নাজমুল মা-বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। ছেলেকে কাছে পাওয়ার স্বস্তি রূপ নেয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। তাদের উচ্ছ্বাস যেন খুশির বাঁধ ভেঙেছে। ছেলের দুই গালে ভালোবাসার চুমুতে ভরিয়ে দেন তারা। এক পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনসহ গ্রামের মানুষ আসতে শুরু করেন নাজমুলের বাড়িতে। পরিচিত মানুষদের কাছে পাওয়ায় নজমুলের আনন্দ বাড়ে আরও কয়েক গুণ।
নাজমুলের বাবা আবু সামা বলেন, ‘সুস্থভাবে আমার ছেলেসহ ২৩ নাবিককে দেশে ফিরিয়ে আনায় বাংলাদেশ সরকার ও জাহাজ কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
ছেলেকে বুকে নিয়ে মা নার্গিস খাতুন বলেন, ‘দিন-রাত ছেলের ছবি এবং মোবাইলে কোনো সংবাদ এলো কিনা এই চিন্তায় বসে থেকেছি। প্রতীক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাইছে না। নাজমুল অপহরণ হওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ওর বাবা। আজ ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের দিন কিভাবে কেটেছে বলতে পারবো না। ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে। এখন আমাদের ঈদ। আমি ঈদের সব কিছুই আজ রান্না করবো। ছেলের সঙ্গে বসে খাবার খাব।’
মা-বাবার পাশে দাঁড়ানো নাজমুল হক বলেন, ‘জিম্মিকালে প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যু আতঙ্কে। বন্দুক হাতে টহল দিত দস্যুরা। ৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারব না। ভেবেছিলাম মা-বাবার মুখ আর দেখা হবে না। আজ বাড়িতে ফিরতে পেরে এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা ছিল না আমার। শুধু বলতে চাই, মা-বাবাকে কাছে পাব, এর চেয়ে আর বড় সুখ কী হতে পারে। এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আল্লাহ আমাদের কথা শুনেছেন।’
প্রসঙ্গ, গত ১২ মার্চ সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ভারত মহাসাগর থেকে জিম্মি হন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর ২৩ জন নাবিক। এদের মধ্যে বন্দি জাহাজের ক্রু হিসেবে ছিলেন সিরাজগঞ্জের নাজমুল হক। জাহাজটি অপহরণের পর থেকে নাজমুলের ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন মা-বাবা, বোনসহ স্বজনেরা। গত (১৪ এপ্রিল) ভোরে জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হন এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজসহ ২৩ নাবিক। এরপর জাহাজটি পৌঁছে দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে। সেখান থেকে মিনা সাকার নামের আরেকটি বন্দরে চুনা পাথর ভর্তি করার পর চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সব মিলিয়ে ৬৫ দিন পর মুক্ত নাবিকরা বাংলাদেশে ফিরেছেন।