স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হচ্ছে প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের সহায়তায় ভারতের মেঘালয়ে ৪৮০ বেডের ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের মাধ্যমে এর যাত্রা। স্বাধীনতার পর সেই হাসপাতাল নতুন করে স্থাপিত হয় ঢাকার ইস্কাটনে। পরে সেটির নাম গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল হয়ে ৩৫ একর জায়গা নিয়ে সাভারে স্থানান্তরিত হয়।
সেই শুরু থেকে আর থেমে থাকেনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। বর্তমানে ঢাকার ধানমন্ডি ও সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুটি টারশিয়ারি হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছয়টি প্রাইমারি রেফারেল হাসপাতাল, ২৫টি প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টার এবং সাতটি হেলথ পোস্ট আছে প্রতিষ্ঠানটির। এছাড়া মেডিকেল কলেজ ও ওষুধ কারখানা রয়েছে গণস্বাস্থ্যের।
স্বাস্থ্যসেবায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবার মনোযোগ দিয়েছে ক্যানসারের চিকিৎসায়। ক্যানসারের রোগীদের বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য এক্সটার্নাল বিম রেডিও থেরাপি (ইভিআরটি) মেশিন সংযোজনে কাজ করছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যানসার বিভাগের সমন্বয়ক ড. এস এম শামিমুল মাওলা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নামকরণ করেন ও জায়গা বরাদ্দ দেন। বর্তমানে ক্যানসারের চিকিৎসায় মনোযোগ দিয়েছি আমরা। বাংলাদেশে দেখা যায়, ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও মানুষ জানতে পারে না। রোগ না বুঝে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি গ্রহণ করায় পুরো শরীরেই ছড়িয়ে পড়ে ক্যানসার। তখন সেটা আর নরমাল থাকে না। চিকিৎসার পর শরীরে যদি ক্যান্সারের একটি সেলও থেকে যায়, তা থেকে আবারও ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমাদের অনেক সতর্কতার সঙ্গেই কাজ করতে হয়।
জফট এক্সেন্ট ইলেকট্রনিক ব্রাকিথেরাপি যন্ত্র
তিনি বলেন, আমরা সাধারণত কারও শরীরে ক্যানসার শনাক্তের পর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেই। সেক্ষেত্রে প্রচলিত ব্রাকিথেরাপিতে (কো-ভাল্ট) ক্যানসার আক্রান্ত টিস্যুর (কোষ) ভেতর রেডিওঅ্যাক্টিভ সোর্স দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এই চিকিৎসায় ক্যানসারের কোষের সঙ্গে শরীরের অনেক কোষও ধ্বংস হয়। ব্রাকিথেরাপিতে ৩০ এমবির মতো রেডিয়েশন তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক রেডিয়েশন নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসারের চিকিৎসায় উচ্চমাত্রার বিকিরণের ফলে কম করে হলেও ৫০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে প্রাণহানি ঘটছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা জফট এক্সেন্ট (Xoft Axxent) ইলেকট্রনিক ব্রাকিথেরাপি দিয়ে এই চিকিৎসা দিচ্ছি, যা মাত্র ৪ এমবি রেডিয়েশন দেয়। এতে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবুও আমরা সচেতন থাকি।
তিনি বলেন, বর্তমানে গণস্বাস্থ্যে আমরা ক্যানসারের ক্ষেত্রে চার ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। এর মধ্যে রয়েছে- ১. ক্যানসার নিরূপণ; ২. ক্যানসার সার্জারি, গাইনি ও প্রসূতি সেবা; ৩. কেমোথেরাপি ও ৪. রেডিওথেরাপি।
ড. এস এম শামিমুল মাওলা বলেন, ক্যানসার রোগীর চিকিৎসায় আমরা দেশে সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক ও নিরাপদ আইসোটোপবিহীন ইলেকট্রনিক ব্রাকিথেরাপি দেওয়া শুরু করেছি। ওষুধ ও থেরাপিসহ মাত্র চার হাজার টাকায় সব হয়ে যায়। রোগীভেদে তিন থেকে সাতটি থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। এর মাধ্যমে জরায়ু, স্কিন ক্যানসার, স্তন ক্যানসার ইত্যাদিতে বিকিরণ আইসোটোপের ঝুঁকিমুক্ত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। এই মেশিনটির ওজন মাত্র ৯০ কেজি, যা সহজে যেকোনো জায়গায় স্থানান্তর করা যায়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যানসার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের ক্যানসার বিভাগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কম খরচে বিশ্বমানের সেবা দেওয়া। ক্যানসারের চিকিৎসায় তিনটি বিষয় আছে- ব্যয়বহুল, কষ্টসাধ্য ও সময়সাধ্য। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্যানসারের রোগী আছে, সে তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক সেবা খুবই কম। সরকারিভাবে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানই আছে, সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ ক্যানসার ইনস্টিটিউট। সেখানে ছয়টি মেশিন আছে। এ মেশিনগুলো অনেক দামি এবং মেইনটেন্যান্স করাও কঠিন। এগুলো যথার্থ মেইনটেন্যান্সের বিষয় থাকে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও এক্ষেত্রে অনেক টাকা ইনভেস্ট কর, সেক্ষেত্রে সেসব জায়গায় খরচের মাত্রাও অনেক বেশি।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ক্যানসার বিভাগের সমন্বয়ক ড. এস এম শামিমুল মাওলা
তিনি বলেন, এক্সটার্নাল বিম রেডিও থেরাপি (ইভিআরটি) মেশিন সংযোজন করা হলে ক্যানসারের বিশ্বমানের চিকিৎসা এখানেই দেওয়া সম্ভব হবে। এটি সংযোজনের চেষ্টা চলছে। হয়তো তিন মাসের মধ্যেই একটা সুখবর দিতে পারবো।
ডা. খোরশেদ আলম বলেন, প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যানসার আক্রান্ত কোষের সঙ্গে শরীরের সুস্থ কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে। কিন্তু ইভিআরটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কাজ করবে এবং সুস্থ কোষ শতভাগ কম না হলেও তা ৮০-৯০ শতাংশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রেডিও থেরাপির এই মেশিন যত উন্নত হবে চিকিৎসা তত বেশি কার্যকর হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা একটি মেশিন আনার চেষ্টা করছি। পরে রোগী বাড়লে আমরা আরও মেশিন আনার পরিকল্পনা করবো।
এই মেশিনের খরচের বিষয়ে বিস্তারিত না জানালেও এই চিকিৎসক বলেন, উৎপাদকরা এই মেশিন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে যদি ৮০ লাখ টাকায় দেয়, সেটা আমাদের ৫০ লাখ টাকায় দেবে। আমাদের কাছে তারা লাভ চাইবে না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মুনাফা ছাড়াই অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের যন্ত্র দেয় বলে জানান তিনি।
এই চিকিৎসক বলেন, গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে বেশিরভাগ রোগীই আসেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এবং বেশিরভাগই গরিব। যে কেমোথেরাপি অন্য কোনো হাসপাতালে নিতে গেলে লাগে ১৪ হাজার টাকা, সেটা আমরা মাত্র সাত হাজার টাকায়ই দিতে পারি। এখানে একটি থেরাপি আছে- থ্রি চ্যানেল ব্রাকিথেরাপি। অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালে এই একটি থেরাপি দিতে সর্বনিম্ন ১৬-১৮ হাজার টাকা ব্যয় হবে। আমরা এখানে ওষুধসহ মাত্র চার হাজার টাকায় দিয়ে থাকি।
খোরশেদ আলম বলেন, আমাদের এখানে একটি বই আছে, যেখানে পাঁচটি ভাগ আছে- অতি দরিদ্র, দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও দুর্বল। এই বইয়ের মাধ্যমে আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী আমরা চিকিৎসামূল্য নিয়ে থাকি। একেবারে রাস্তায় যারা থাকেন, তাদের আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। এছাড়া বীরাঙ্গনাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কম খরচে চিকিৎসা দিয়ে থাকি।
কীভাবে কম খরচে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার কারণ হলো সিট ভাড়া, চিকিৎসক খরচ কম। কোনো দালালের মাধ্যম ছাড়াই এখানে রোগীরা সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলে চিকিৎসা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তি নানা সময় আমাদের অনুদান দিয়ে থাকেন। এছাড়া অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোম্পানিগুলো আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। ফলে গণস্বাস্থ্যকে টাকার জন্য আটকে থাকতে হয়নি কখনো।