আমরা অনেক সময় বলে থাকি, প্রকৃতি থেকে প্রতিরক্ষা—বাংলাদেশের সবকিছুতেই জড়িয়ে রয়েছে নদী। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিষয়টি আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের আগে ষাটের দশকে বাঙালির যে স্বাধিকার আন্দোলন, সেখানেও নদী কতটা প্রাসঙ্গিক ছিল বোঝা যায় বিখ্যাত স্লোগানে নদী উঠে আসার মধ্য দিয়ে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে আমাদের স্লোগান ছিল ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। কয়েক মাস আগে ওই গণআন্দোলনের নায়ক তোফায়েল আহমেদের কাছে কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম, এমন স্লোগান তাঁরা কেন গ্রহণ করেছিলেন? মৃদু হেসে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন—‘আমরা নদীর দেশ না?’
বাংলাদেশ যে আসলে ‘নদীর দেশ’ তা কেবল মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকালেও অনেক উদাহরণ মেলে। ষাটের দশকে বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা যেন মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে নদীকেই কেন্দ্র করে। কেবল আরো অনুসন্ধান ও উন্মোচন জরুরি। যেমন এই লেখা যেদিন লিখছি, সেদিন শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। তাঁদেরই একজন শহিদ আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ যতখানি বিখ্যাত, তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নদী নিঃশেষিত হলে’ যেন ততটাই নিভৃতচারী। মায় আমিও জানতাম না যে, তিনি সেই ১৯৬৩ সালে প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন এবং এখনো বাজারে পাওয়া যায়। একই নামের কবিতায় তিনি বলছেন—‘বর্ষার আশায় মাঝি নৌকা সারে/ পার হবে এপারের লোক/ এখন রৌদ্রে বুঝি রাঙা হ’ল পৃথিবীর একটি অশোক।’ কবিতাটিতে স্বাধীনতার প্রস্তুতি, মানুষের অপেক্ষা আর রাঙা দিনের আভাস স্পষ্ট নয়?
আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে নদী যে নির্ধারক শক্তি হয়ে উঠবে স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে বেশি কে জানত? বঙ্গবন্ধু বিলক্ষণ জানতেন বাংলাদেশের মূলশক্তি নদ-নদী। তাই আমরা দেখি, ঐতিহাসিক সাত মার্চের ভাষণে তিনি বলছেন—‘আমরা ওদের পানিতে মারবো’। আমরা এও দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকাল তাঁর এই হুঁশিয়ারি অমোঘ সত্যে পরিণত হয়েছিল। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বৃহত্ নদীবিচ্ছিন্ন বা বিল ও হাওর এলাকাগুলোতে যেতে পারেনি। সেখানে গড়ে ওঠা মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং অধিকৃত এলাকায় গেরিলা হামলা চালিয়েছেন। বর্ষাকালে যখন দেশের নদীগুলো টইটম্বুর হয়ে উঠতে শুরু করে; মুক্তিযোদ্ধারা যখন নদীপথ ধরে একের পর এক ‘গাবুরা মাইর’ শুরু করে; তখন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত ঢাকার দিকে পিছুহটা ছাড়া উপায় ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে নদী কীভাবে অবদান রেখেছে, তার খানিকটা ব্যক্তিগতভাবে আমিও জানি। আমার জন্ম যে এলাকায়, কুড়িগ্রামের রৌমারী, তা নয় মাস জুড়েই ছিল ‘মুক্তাঞ্চল’। বৃহত্তর রৌমারী বা আজকের রৌমারী-রাজীবপুর উপজেলা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসই মুক্তাঞ্চল তথা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নোংরা পদচিহ্নমুক্ত ছিল মূলত বিপুল ব্রহ্মপুত্রের আশীর্বাদে। পাকিস্তানি বাহিনীর সাহস হয়নি নদীটি পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করতে যাওয়ার। সেই সুবাদে ওই পলল ভূমিতে গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা। একবার পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে রৌমারী হামলা করতে গিয়েছিল। কিন্তু নদীমাতৃক দেশের যোদ্ধাদের সঙ্গে তারা পারবে কীভাবে? কোদালকাটি চরে বুকের রক্ত দিয়ে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
এই এলাকারই মেয়ে তারামন বিবি স্বাধীনতার পর ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পান ওই যুদ্ধে অসম সাহসী ভূমিকার জন্য।
নদী যে কেবলই প্রতিবেশ-অর্থনীতি-কূটনীতির ব্যাপার নয়, বাংলাদেশের জন্য বরং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও অংশ—এ তত্ত্বের প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করেছিলেন পুলিত্জার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গও। কেবল রৌমারীতে নয়, গোটা দেশেই মুক্তিযুদ্ধে নদ-নদী কীভাবে ‘দ্বিতীয় বাহিনী’ হয়ে উঠেছিল, তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলেন ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ ডেটলাইনে—‘বাঙালিরা নির্ভর করছে বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির ওপর, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যা শুরু হবে। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের জটিল পথ—গাঙ্গেয় ব্রহ্মপুত্র জলধারা ও সহস্র নদীর আঁকিবুঁকি—পশ্চিম প্রদেশের শুষ্ক ও পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত পাঞ্জাবি ও পাঠানদের কাছে অপরিচিত। যখন বর্ষায় নদী ফুলে উঠবে এবং মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়বে, তখন এই অপরিচিতি আরও বাড়বে।’
‘আমরা এখন বর্ষার অপেক্ষায় রয়েছি’, বললেন এক বাঙালি অফিসার। ‘তারা পানিকে এত ভয় পায় যে আপনি ভাবতেই পারবেন না এবং আমরা হচ্ছি জলের রাজা। তারা তখন ভারী কামান ও ট্যাংক নিয়ে চলতে পারবে না। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী’। (ডেটলাইন বাংলাদেশ :নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান, সিডনি শনবার্গ, মফিদুল হক অনূদিত, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৫)। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে সিডনি শনবার্গের নিজের বই ‘বিয়োন্ড দ্য কিলিং ফিল্ড’ প্রকাশিত হয়। এর তৃতীয় অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের এই বন্ধুর অভিজ্ঞতা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ‘কনভেনশনাল’ যুদ্ধেও নদীর প্রাসঙ্গিকতা থাকবে না, তা কী করে হয়? আমরা জানি, শৃঙ্খলার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গোটা রণাঙ্গনকে মোট এগারোটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি সেক্টরে এক-একজন সেক্টর কমান্ডার থাকলেও ১০ নম্বর সেক্টরে ছিল না। কারণ এর আওতাভুক্ত ছিল দেশের সব নদী ও সমুদ্রবন্দর এবং উপকূলীয় জলসীমা। এই সেক্টরে সংলগ্ন সেক্টরগুলোরই কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
মার্চের শুরুর দিকের একটি ঘটনা পৃথক নৌ-কমান্ডো গঠনের পথ খুলে দেয়। তখন পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায়। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৮ জন দলত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে আসেন। তাঁদের নিয়ে নৌ-কমান্ডো গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণের যে স্থান নির্ধারণ করা হয়, তাও কম কৌতূহলউদ্দীপক নয়। মে মাসে ঐতিহাসিক পলাশীর পাশে ভাগীরথী নদীতে শুরু হয় গোপন প্রশিক্ষণ। সেখানে তৈরি হয় তিন শতাধিক নৌ-কমান্ডো। যে পলাশীতে একদিন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য সেখানেই প্রস্তুত হয় বাংলাদেশের প্রথম নৌবাহিনী।
এই কমান্ডো দেশের অভ্যন্তরে যেসব অভিযান পরিচালনা করে, তার মধ্যে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ সবচেয়ে স্মরণীয়। এটি ছিল নৌযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে সফলতম গেরিলা অপারেশন। একাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্র বন্দর এবং চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে একযোগে অসীম সাহসের সঙ্গে হামলা চালায় আমাদের নৌযোদ্ধারা। নৌযোদ্ধারা প্রায় খালি গায়ে যেভাবে এই হামলা চালায়, তার নজির বিশ্বের আর কোথাও রয়েছে বলে জানা নেই। এই গেরিলা অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর বেশকিছু অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তার মধ্যে বিদেশি কিছু জাহাজও ছিল। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর খবর। অন্যদিকে মনোবল ভেঙে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর। এখন স্পষ্ট, পরবর্তী সময়ে নৌযুদ্ধেই পাকিস্তানি বাহিনী হারতে থাকে। ভারতীয় জেনারেলদের নানা সাক্ষাত্কারেও দেখেছি, তাঁরা বাঙালির নৌ-দক্ষতা সম্পর্কে জানতেন।
শুধু চূড়ান্ত যুদ্ধে নয়; এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরেও, ২৬-২৭ মার্চ, বলতে গেলে আক্রান্ত ঢাকার জন্য ত্রাতা হয়ে এসেছিল ঢাকার চারপাশের নদীগুলো। ঢাকাবাসী প্রথম সুযোগেই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আমরা দেখি, হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সাক্ষীও বুড়িগঙ্গা। রায়েরবাজারের যে স্থানে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেটা ছিল আদতে আদি বুড়িগঙ্গার নদীখাত। মুক্তিযুদ্ধে আরো যেসব শহিদের লাশের খোঁজ মেলেনি, আমি নিশ্চিত তাঁরাও মিশে আছেন তাঁদের প্রিয় স্বদেশের নদ-নদীতে। আর নদ-নদীর মতোই আমাদের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে চলছে তাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। তাই আমাদের নদীগুলো নিছক পানিপ্রবাহ নয়, এর সঙ্গে মিশে রয়েছে বুকের তাজা রক্ত।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নদ-নদীর অসামান্য অবদান কি আমরা মনে রেখেছি? স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকের মাথায় বিজয় দিবসে এসে নিজেদেরকেই প্রশ্নটি করতে হবে। যে প্রকৃতি ও প্রতিরক্ষা নদীনির্ভর, নদীই যদি না থাকে, তাহলে তার ভিত্তিই কি নড়বড়ে হয়ে যায় না? দেশের স্বাধীনতার জন্য যেমন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলাম, তেমনই নদী সুরক্ষার লড়াইয়েও জাতীয় ঐকমত্য আজ জরুরি। আমাদের স্বাধীনতার জন্য যেমন নদী সহযোদ্ধা বেশে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তেমনই দখল, দূষণ, ভাঙন, প্রবাহস্বল্পতায় হাঁসফাঁস করতে থাকা নদীর মুক্তির জন্য আমাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বিজয় দিবসে লাখো শহিদ, মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রম হারানো মা-বোন, সবার প্রতি জানাই নদীময় শুভেচ্ছা।
লেখক :গবেষক, মহাসচিব, রিভারাইন পিপল