বাংলাদেশের পরিক্ষিত বন্ধু দেশ জাপান। দেশের নানা অবকাঠামো উন্নয়নে নানাখাতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে জাপান। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার এবং জাপান সরকারের মধ্যে দুটি বিনিয়োগ প্রকল্প এবং একটি বাজেট সহায়তা সংক্রান্ত ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ জন্য মোট দুই দশমিক ৬৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময় নোট ও ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ। প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এই বিনিয়োগের পরিমাণ ২২ হাজার ৬৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সোমবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর শেরে বাংলানগরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির মধ্যে এই বিষয়ে বিনিময় নোট চুক্তিসই হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত জাইকা অফিসের চিফ রিপ্রেজেন্টেটিভ ইউহো হায়াকাওয়ার সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
এ সময় অর্থ বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, সিপিজিসিবিএল, সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর, পিজিসিবি, ডিএমটিসিএল, জাপান দূতাবাস এবং জাইকা বাংলাদেশ অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জাপান সরকারের ৪২তম ওডিএ লোন প্যাকেজের আওতাধীন বিনিয়োগ প্রকল্প দুটির জন্য স্বাক্ষরিত ঋণের বাৎসরিক সুদের হার নির্মাণ কাজের জন্য শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ, পরামর্শক সেবার জন্য শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ। এছাড়া ঋণের এককালীন শূন্য দশমিক ২ শতাংশ হারে পরিশোধ করতে হবে। এ ঋণ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য।
বাজেট সাপোর্ট ঋণের বাৎসরিক সুদের হার শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, এককালীন শূন্য দশমিক ২ শতাংশ দিতে হবে। এ ঋণ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য। ওই ঋণচুক্তির অধীনে কক্সবাজারের মহেশখালি উপজেলায় মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট (৬০০ মেগাওয়াট X২ ইউনিট ) আলট্রা সুপার ক্রিটিকাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ চলছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ দশমিক ৪৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে জাইকা ঋণ ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদকাল জুলাই ২০১৪ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত। অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫১ শতাংশ। জাইকা কর্তৃক পর্যায়ক্রমে ঋণ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ৫টি পর্যায়ে মোট তিন লাখ ৫০২ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েনের (২.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ৪২তম ওডিএ লোন প্যাকেজের (১ম ব্যাচ) আওতায় ষ্ঠ পর্যায়ে এক লাখ ৩৭ হাজার ২৫২ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন (১.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রদান করা হবে।
মেট্রোরেল-১ প্রকল্প দুটি অংশে বিভক্ত। এর মোট দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। বিমানবন্দর রুট (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) এবং পূর্বাচল রুট (নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো)। বিমানবন্দর রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার এবং মোট পাতাল স্টেশনের সংখ্যা ১২টি। এ রুটেই বাংলাদেশে প্রথম পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মিত হতে যাচ্ছে। পূর্বাচল রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। সম্পূর্ণ অংশ উড়াল এবং মোট স্টেশন সংখ্যা ৯ টি। নতুন বাজার স্টেশনে ইন্টার চেঞ্জ থাকবে। উভয় রুটের সকল বিস্তারিত স্টাডি, সার্ভে এবং বেসিক নকশা সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে ডিটেইলড নকশার কাজ চলমান আছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৫২ হাজার ৫৬১ দশমিক ৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের মেয়াদকাল সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ডিসেম্বর ২০২৬ পর্যন্ত। এতে জাইকা কর্তৃক পর্যায়ক্রমে ঋণ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের জন্য পাঁচ হাজার ৫৯৩ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন এবং নির্মাণ কাজের জন্য ১ম পর্যায়ে ৫২ হাজার ৫৭০ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েনের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে । ৪২তম ওডিএ লোন প্যাকেজের (১ম ব্যাচ) আওতায় ২য় পর্যায়ে এক লাখ ১৫ হাজার ২৭ মিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন (১.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রদান করা হবে।
করোনা সংকটে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ঋণ দিচ্ছে দেশটি। এর উদ্দেশ্য হলো কার্যকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, কোভিড-১৯ অতিমারি সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দা উত্তরণে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাজেট সাপোর্ট প্রদান করা। এর আওতায় জাপান সরকার ৪০ বিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন (৩৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ সহায়তা প্রদান করবে। এ ঋণের বাৎসরিক সুদের হার শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, এককালীন শূন্য দশমিক ২ শতাংশ দিতে হবে। এ ঋণ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য। ইতিপূর্বে ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাজেট সাপোর্ট হিসেবে জাপান সরকার ১ম পর্যায়ে ৩৫ বিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন (৩২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। দ্বি – পাক্ষিক পর্যায়ে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ।