শওকত হোসেন হিরন শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরিশালের মানুষের কাছে আস্থা এবং নির্ভরতার প্রতীক হতে পেরেছিলেন।কথা এবং কাজের মেলবন্ধন তিনি তৈরি করে দেখিয়েছিলেন, মাত্র সাড়ে চার বছরে তিনি একটি মফস্বল শহর কে আমূল পরিবর্তন করে ছিলেন, যেটা আমাদের কাছে ছিল বিস্ময় জাগানিয়া! সত্যিকার অর্থেই তিনি একটি তিলোত্তমা নগরী উপহার দিতে পেরেছিলেন।যদি আলোকসজ্জার কথা বলি, মেয়র নাইট এর কথা বলি, কিংবা নৌকাবাইচ, দুই লেইনের রাস্তা, এমন অসংখ্য প্রথম এর সাথে নগরবাসীকে পরিচয় করে দিয়েছিলেন শওকত হোসেন হিরন। এমনকি সূর্যোদয়ের পূর্বে নগরের বর্জ্য পরিষ্কার করিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
তিনি যেমন উন্নয়নের ধারা তৈরি করেছিলেন,ঠিক তেমনি তিনি রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন, রাজনীতির সহবস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। যা বরিশালের রাজনীতিতে অপরিচিত ছিল। তিনি সবাইকে এক করতে পেরেছিলেন এবং অসম্ভব রকমের দৃঢ়চেতা ছিলেন, তিনি সব সময় মানুষের মাঝে থাকতেন, এমনকি তাকে ফোন করে কথা বলা যেত এবং নির্দিষ্ট সময়ে বাসায় তার সাথে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়া যেত, কোন ধরনের কাঠ খড় পোহানো ছাড়াই! এটিই ছিল তাঁর নেতৃত্বের অন্যতম গুণ, আর এ কারণেই তিনি জনগণের হিরন হতে পেরেছিলেন।
এত বছর পরেও বরিশালের ওলি গলিতে কান পাতলে শোনা যায় মেয়র হিরণের কীর্তি গাঁথা।এখন ও নগরের যেখানেই চোখ যায়, হিরনের কাজের ছাপের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। বর্তমানে বরিশাল নগরের সবুজ বৃক্ষও অর্ধেকের বেশি হিরনের লাগানো। স্বপ্ন ছিল সবুজের নগর তৈরির। রাস্তায় টিস্যু, থুতু ফেলতে নিষেধ করতেন হিরন। সবাইকে নিজের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদ দিতেন। সূর্য ওঠার আগে নগরের আবর্জনা সরিয়ে নিতেন তিনি।
৩০ ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি থেকে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা অপসারণের উদ্যোগও তাঁর হাত ধরেই চালু হয়েছিল। নগরে বালুর গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং রাত জেগে তার তদারক সবই হিরনের দেখানো পথ। নগরের সড়ক প্রশস্তকরণ, আলোর নগরে পরিণত করা, ফুটপাত নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিনোদনকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা—সর্বত্র অবদান ছিল হিরনের। তাই তো এত বছর পরেও হিরন সবার কাছে এত প্রিয় ।হিরন বরিশাল সিটির মসনদে বাসার আগে যাঁরা বরিশালে এসেছেন, তাঁরা দেখেছেন, একটি দুর্গন্ধ জঞ্জালের নগর ছিল বরিশাল।
সেই সব জঞ্জাল সরিয়ে বরিশাল নগরকে নান্দনিক সৌন্দর্য দিয়েছিলেন হিরন। দলমত-নির্বিশেষে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টিতে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলন উপলক্ষে নগরে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাসহ দলের নেতা-কর্মীদের বিলবোর্ডে ছেয়ে যায়। দুই দিন পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরিশালে আসেন জনসভা করার জন্য। শওকত হোসেন হিরন ওই জনসভা সফল করার জন্য দলের সব বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলেন। সেই সব স্থানে মুহূর্তের মধ্যে খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের ছবি, বিলবোর্ড স্থান পায়।
ওই জনসভা যাতে সফল হয়, সে জন্য আগের দিন বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিএনপির জনসভাস্থল পরিদর্শন করেন। বরিশালের ইতিহাসে কোনো ধরনের হামলা ও সহিংসতা ছাড়া বিএনপির ওই জনসভা সফল হয়। যা আজও বিএনপির অনেক নেতা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন।১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বরিশালে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস, অন্য দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের সব ঘটনা বন্ধ হয়ে যায় হিরন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। পাশাপাশি অবস্থান করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দল রাজনীতি করেছেন। হামলা-মামলার ঘটনা প্রায় শূন্যে দাঁড়িয়েছিল হিরনের কল্যাণে। যার ফলশ্রুতিতে বরিশাল নগর শান্তির নগর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল ।
নগরের মানুষদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও হিরন ছিলেন নগরবাসীর প্রাণের মানুষ।তিনি যে দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেই খবর শুনে বরিশালের এমন কোন মানুষ ছিল না যারা ব্যাকুল কিংবা উৎকন্ঠিত হননি। বরিশালের মানুষ তাকে আপন করে দল-মত-নির্বিশেষে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ঠিক যেমনি, তিনি মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন। যার প্রমাণ তার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পরে তার জানাজায়, দল মত বর্ণ পেশা ছাঁপিয়ে লক্ষ্য মানুষের উপস্থিতি।
আজ তিনি হয়তো শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু বরিশাল নগরীর প্রত্যেকটি স্থানে, তার কর্ম জানান দিচ্ছে তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, বরিশালের মানুষের অন্তরের অন্তস্থলে।যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন আধুনিক বরিশালের রুপকার প্রিয় হিরণ।শওকত হোসেন হিরণ হয়তো আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার স্মৃতিগুলো আজ এত বছর পরও জীবন্ত। কৃতজ্ঞতা চিত্তে শ্রদ্ধা,সম্মান ও ভালোবাসা জানাই অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডি ক্রাইম২৪ ডট কম পত্রিকার পক্ষ থেকে ।