করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই এবার বরিশাল রয়েছে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা ঝুঁকিপূর্ণ জেলার তালিকায়ও বরিশালের অবস্থান রয়েছে শুরু থেকেই।
বলা হচ্ছে, বাজার ও গণপরিবহন এই দুইস্থান থেকে সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে।এই স্থানে আসা মানুষই সর্বোচ্চ করোনা সংক্রমিত হচ্ছেন বা তাদের শরীরেই সংক্রমণের আশঙ্কা খুব বেশি।
এরপরও বরিশালের সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যূনতম করোনা ভীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও সোমবার (১২ এপ্রিল) সকাল থেকে বৈশাখী কেনাকাটার জন্য নগরীর চকবাজার এলাকার মার্কেটে জনস্রোত নেমেছে।
সকাল থেকে ভিড় ঠেলে মানুষ চাঁদ রাতের মতো করেই নিজের ও পরিবারের জন্য কেনাকাটা সারছেন। দুইদিন পরই কঠোর লকডাউন।
তাই কেউই যেন এই হাতে থাকা সামান্য সময়টুকু নষ্ট করতে চাইছেন না। জীবনের মায়া ভুলে উৎসবে গা ভাসাতে বেশিরভাগ মানুষই এখন মার্কেট ও বিপণিবিতানমুখি! অথচ প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকার মানুষ করোনা সংক্রমিত হচ্ছে।
বরিশালে লাফিয়ে বাড়ছে করোনা শনাক্তের হার। কিন্তু সব শেষ গত দুইদিনের পরিসংখ্যান বিস্মিত করেছে খোদ স্থানীয় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরকেই।
রোববার দুপুরে নগরীর চকবাজার এলাকার একটি বিপণী বিতানে শিশু সন্তানকে নিয়ে হাজির হন রোকসানা বেগম।
উদ্দেশ্য চৈত্রের ছাড়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু পোষাক কেনা। দুজনের মুখেই ছিলো না মাস্ক। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, একবছরেও তো করোনা হলো না।
এখন আর হবে না। সম্প্রতি দেশজুড়ে হওয়া আন্দোলন সংগ্রাম ঠেকাতেই সরকার বেশি বেশি করোনা রোগীর সংখ্যা প্রচার করছে৷
শনিবার সন্ধ্যায় নগরীর ঈশ্বরবসু সড়কে ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছিলো মোঃ নান্নু। হঠাৎ সরকারি বিধিনিষেধের তদারকিতে সেখানে একটি পুলিশের টিম উপস্থিত হয়।
পুলিশের তৎপরতা দেখে ভ্যান রেখেই গা ঢাকা দেন তিনি। আধাঘন্টা পর অবশ্য তাকে পুনরায় সেখানে ভোক্তাদের ডাব কেটে দিতে দেখা যায়।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, হঠাৎ পুলিশ এভাবে চলে আসবে ভাবি নি। হয়তো মারতে পারে এমন ভয়তে ভ্যান রেখে পালিয়ে গিয়েছিলাম।
ডাবগুলো বিক্রি না করতে পারলে সংসার চলবে না তাই বাধ্য হয়ে পুনরায় বিক্রি শুরু করেছি।সারাদেশের সঙ্গে সঙ্গে বরিশালেও বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা।
হাসপাতালে তীল ধারণের জায়গার অভাব বাড়ছে রোজ। সংক্রমণ রুখতে আগামী ১৪ই এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের (অবরুদ্ধ) ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
তবে বর্তমানে চলমান বিধিনিষেধের মধ্যেই স্বাস্থ্য সচেতনতায় মানুষের উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে।
স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষার পিছনে অর্থনৈতিক কারণও সামনে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহলের দাবি গণমানুষের এমন অসচেতন আচরণ আসন্ন লকডাউনকে অকার্যকর করে দেবে।
যার দরুন বিপদে পড়তে পারে সকলে।স্বাস্থ্যবিধি না মানার পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে এলো জনসাধারণের উদাসীনতা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল এ ব্যাপারটিকেই চিহ্নিত করেছেন।
তিনি বলেন, প্রথম যখন করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে আক্রমণ করলো তখন সবার ধারণা ছিল জীবাণুটি দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু।
কিন্তু একবছরে যারা আক্রান্ত হন নি তারা এখন উদাসীন আচরণ করছেন। তাদের ধারণা কখনোই করোনা তাদের আক্রান্ত করতে পারবে না।
যে কারণে এ ধরণের উদাসীন মানুষের স্বাস্থ্য বিধি উপেক্ষার ফলে ঝুঁকিতে পরছে সবাই।অন্যদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রিফাত ফেরদৌস জানান, মূলত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
তিনি বলেন, বর্তমানে মানুষের কাছে জীবনের চেয়ে জীবিকা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই চাইলেও বাসায় থাকা কিংবা অতিরিক্ত টাকা খরচ করে নিয়মিত করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী (মাস্ক, জীবাণুনাশক ইত্যাদি) কেনা সম্ভব হচ্ছে না।
এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, গতবছর প্রথম পর্যায়ে লকডাউন দেবার পর মানবিক ও সরকারি সহায়তা নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল অনেকে।
অনেকে সেসময় জমানো টাকা খরচ করেছে। কিন্তু বর্তমানে সহায়তা তুলনামূলক কমে গেছে এবং জমানো টাকা হারিয়েছে অনেকে।
এছাড়া কর্মহীন হয়ে পরার বা কর্ম হারানোর ভয়ে আছে অনেকে। এসব কারণে বাড়ির বাইরে বেরুতেই হচ্ছে দেশের জনগণকে।সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, যে হারে মানুষ করোনা সংক্রামিত হচ্ছে এবং আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে তা ঠেকাতে কঠোর লকডাউনের কোন বিকল্প নেই।
কিন্তু বর্তমানে মানুষের মধ্যে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কোন বালাই নেই। বাজার, শপিংমল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সবখানে জনসমাগম হচ্ছে কিন্তু নূন্যতম করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী ব্যবহার করছে না কেউ।
এমতাবস্থায় প্রশাসন শক্ত ভূমিকা না নিলে আসন্ন লকডাউন কার্যকর না হবার শঙ্কা আছে।বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন রোববার জানিয়েছেন, বিভাগের একমাত্র করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র নগরীর শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সেখানে ১৫০ শয্যার করোনা ইউনিট ও ১০ শয্যার আইসিইউ রয়েছে। সাধারণত করোনা আক্রান্ত হয়ে জটিল শারীরিক সমস্যা ছাড়া কেউ হাসপাতালে আসে না। শনিবার শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে রোগী ভর্তি ছিল ১২৬ জন।
এছাড়া সকল আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি আছে।এদিকে বরিশাল জেলার করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ বিষয়ক কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, গত ১০ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল জেলায় ৫ হাজার সাতশো ১৯ জন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত একদিন সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হবার রেকর্ড হয়েছে গত ৭ই এপ্রিল।
সেদিন জেলায় ১০৭ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়।এরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সকলের স্বাস্থ্য বিধি পালন করার কোন বিকল্প নেই। যদি বরিশালবাসী সচেতন না হয় তবে কঠোর হবে প্রশাসন।