বরিশালের গৌরনদীতে অরক্ষিত ১৩৫ শহীদের মরার ভিটার বধ্যভূমি

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

শামীম আহমেদ॥ পাক সেনাদের সেইদিনের নির্বিচারে গুলির শব্দ এবং গুলিবিদ্ধ নর-নারী ও শিশুদের আর্তনাত আজো আমার কানে ভেসে বেড়ায়। যখনই নির্মম ঘটনার কথা মনে পরে, তখনই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে থাকে। ভয়ে আজো আতঁকে উঠি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পরেও সেইদিনের লোমহর্ষক ঘটনা আজো ভুলতে পারিনি।

সেদিন পাক সেনাদের গুলিতে ১৩৫ জন নর-নারী ও শিশু একইস্থানে নির্মম হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন। পরবর্তীতে নিহতের ২/১ জন স্বজনরা কয়েকটি লাশ এখান থেকে নিয়ে গেলেও সিংহভাগ লাশ একইস্থানে পরেছিলো। তখন নির্জন এ জঙ্গলে শহীদদের লাশ শেয়াল-কুকুরে ছিরে খেয়েছে। বেশ কয়েকদিন পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এখানে এসে লাশগুলো একটি ডোবার মধ্যে রেখে মাটি চাঁপা দিয়েছিলেন।

অশ্রু সজল নয়নে কথাগুলো বলছিলেন, পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারানো ১৩৫ জন শহীদের নির্মম মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর হরহর গ্রামের শহীদ পরিবারের সন্তান মৃত অনিল চন্দ্র দাসের ছেলে মনোতোষ দাস (৬৪)। পাকসেনাদের নির্মম গুলিতে সেদিন শহীদ হয়েছিলেন মনোতোষ দাসের ঠাকুর দাদা অশ্বিনী কুমার দাস।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাত হোসেন রাসু বলেন, পাক সেনাদের ভয়ে ১৯৭১ সালের ১৫ মে হরহর গ্রামের নন্দিপাড়ার বনজঙ্গল বেষ্টিত জলাভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন আশপাশ এলাকার কয়েকশ’ হিন্দু পরিবারের বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশুরা। বিষয়টি জানতে পারে পাক বাহিনীর দোসর বাটাজোর ক্যাম্পের রাজাকাররা। তারা পাক সেনাদের নিয়ে সেদিন দুপুরে বন-জঙ্গল ঘেরা ওইস্থানে আক্রমন চালায়। হানাদাররা নিরীহ জনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষন করে। এতে প্রায় ১৩৫ জন ব্যক্তি শহীদ হন। তাদের মধ্যে পাঁচ মাসের শিশু থেকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ছিল এবং অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। সেদিন পাকসেনাদের দোসরা ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছিলো।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উৎপল চক্রবর্তীর লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাটাজোর ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একইদিন একইস্থানে ১৩৫ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল বলেই গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর এলাকার ওই বধ্যভূমির নামকরণ করা হয়েছে ‘মরার ভিটা’। হরহর গ্রামের নন্দী পাড়ার সেই দুর্গম ও নির্জন জঙ্গলটি আজও ভয়াল দিনের স্মৃতি বহন করে চলছে। এখনও ওই স্থানের মাটি খুড়লে শহীদদের মাথার খুলি, কংকাল ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। সেখানে আজও থমথমে ভাব বিরাজ করছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহজাহান সরদার বলেন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পরেও বাটাজোর ইউনিয়নের হরহর এলাকার ১৩৫ শহীদের স্মৃতি বিজড়িত মরার ভিটায় আজো নির্মিত হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। এমনকি এ বধ্যভূমিতে আসার একমাত্র মাটির রাস্তাটিরও বেহাল দশা। গত সাতবছর থেকে বিজয়ের মাস আসলেই জনপ্রতিনিধি ও সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তারা অরক্ষিত এ বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসার পর স্মৃতি স্তম্ভ ও রাস্তা নির্মানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়না। ফলে আজো ১৩৫ শহীদের বধ্যভূমিতে কোন স্মৃতি স্তম্ভ কিংবা কাঁচা রাস্তাটি নির্মান করা সম্ভব হয়নি।

বাটাজোর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কাদের হাওলাদার বলেন, সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়া এক মায়ের দুগ্ধ পান করা অবস্থায় ৭/৮ মাস বয়সের এক শিশুপুত্রকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। যা ছিলো এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। ওই শিশুও সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন।

সেদিনকার সেই ছোট শিশু অবিলাষ নন্দী (৫০) ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও এ হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত স্থানীয় রাজাকারদের আজো বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এমনকি শহীদ পরিবার হিসেবেও আমাদের কোন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সম্মানি নয়; অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে যেন আমাদের একটি সনদ প্রদান করে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যা দেখে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারবে স্বাধীনতা যুদ্ধের আত্মত্যাগের কথা।

স্থানীয় অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, সেদিন পাক সেনাদের সাথে উপস্থিত থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলো স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আদম আলী মাষ্টার, তার সহযোগী মানিক রাঢ়ী, খাদেম সরদার, জব্বার সরদার, আক্কাস আলী বেপারীসহ তাদের অন্যান্য সহযোগীরা। মুক্তিযোদ্ধা, এলাকাবাসী ও শহীদ পরিবারের স্বজনরা দ্রুত জীবিত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতারপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং শহীদ পরিবারের স্বীকৃতিসহ ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে মরার ভিটার বধ্যভূমির স্মৃতি রক্ষায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ ও যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বাধীনতার স্বপক্ষের সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।