বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রত্মপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামের আব্দুল গফুর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে নিজ বাড়িতে বসে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অথচ তার নাম এসেছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
এছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকায় নাম আসা অন্য তিনজনের কবরস্থান সরকারিভাবে বাঁধাই করার তালিকা হাতে পেয়ে সরেজমিন তদন্তে কবরের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি।
এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অস্তিত্ববিহীন এসব কবরস্থান বাঁধাইয়ের টেন্ডার আহ্বান করা নিয়েও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে।
জানা গেছে, ২০২০ সালে প্রকাশির মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের শহীদ বেসামরিক গেজেটে আগৈলঝাড়া উপজেলার বারপাইকা গ্রামের আব্দুর রহমান শিকদারের ছেলে শহীদ আবদুল গফুরের নাম লেখা রয়েছে। এছাড়াও ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় বরিশাল বিভাগের বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলায় শহীদ আবদুল গফুরের নাম রয়েছে। তবে, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলে সংরক্ষিত ১৬ জন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আবদুল গফুরের নাম নেই কোথাও।
এদিকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (১ম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গণপূর্ত অধিদপ্তর আগৈলঝাড়াসহ বরিশালের বিভিন্ন উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান নির্মাণ করার কার্যক্রম হাতে নেয়। এর লক্ষ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে জেলা প্রশাসন কাছে একটি লিখিত পত্র আসে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থান শনাক্ত করে বুঝিয়ে দিয়ে ইউএনওদের মাধ্যমে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তালিকা পেয়ে উপজেলা সমাজসেবাকে গত ৯ মে যাচাই-বাছাই পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সরজমিনে পরিদর্শনে নামেন।
সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা জানান, তার পরিদর্শনকালে তালিকাভুক্ত শহীদ আব্দুল মান্নান মোল্লা, শহীদ সামচুল হক মোল্লা, শহীদ তৈয়ব আলী বখতিয়ারের কবরস্থান তাদের বাড়িতে দেখতে পাননি। তবে, তাদের নাম উপজেলা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা তার পরে তাদের মরদেহ খুঁজে পায়নি বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।
তিনি জানান, এর বাইরে শহীদ আবদুল গফুরের কবরের অনুসন্ধানে তার নিজ বাড়ি বারপাইকা, রত্নপুর গ্রামে গিয়েছিলেন। আর তার আগমনের বিষয়টি জানতে পেরে ওই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে জড়ো হন এবং শহীদ আবদুল গফুর কোন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন মর্মে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।
এ বিষয়ে রত্নপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউনিয়ন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান জানান, শহীদ গেজেট ধারী আবদুল গফুর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আমলে নিজ বাড়িতে বসে কলেরা রোগে মারা গেছেন, সে কি করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আসেন।
সাবেক কমান্ডার মো. ফারুক ভূইয়া জানান, স্বাধীনতা সংগ্রামের আগেই কলেরায় মারা যাওয়া ব্যক্তি যদি শহীদ গেজেটের তালিকায় আসেন সেটা আমাদের জন্য কলংকের, আমরা এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা এর তীব্র বিরোধিতা করছি।
আবদুল গফুরের সহপাঠী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মো. সোহরাব উদ্দিন জানান যে, আবদুল গফুর আমার সহপাঠী, তার ডান হাতের কব্জি ছিল না, সে বাম হাত দিয়ে খাবার খেতো ও লিখতো। তাছাড়া সে ১৯৬৮ সালে নিজ বাড়িতে বসে কলেরা রোগে মারা গেছে। সে সময় আমরা বাড়িতেই ছিলাম। আমার প্রশ্ন হলো তার নাম কী করে শহীদ গেজেটে আসে?
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সহকারী কমান্ডার ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রত্নপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. লিয়াকত আলী হাওলাদার জানান আগৈলঝাড়া উপজেলায় ১৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে আমরা জানি। যাদের প্রতি বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে উপজেলা প্রশাসন থেকে সম্মাননা দেওয়া হয় এর বাইরে কোন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমার জানা মতে আমাদের উপজেলায় নেই।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাশেম সাংবাদিকদের বলেন, অস্তিত্বহীন এবং বিতর্কিত ব্যক্তিদের কিভাবে মন্ত্রণালয় তালিকা করেছে তা তার জানা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পাঠানও চার জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে। এখনও সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা প্রতিবেদন দাখিল করেননি। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন যে, তালিকার তিন জন প্রকৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও তাদের মরদেহ না পাওয়ায় কবরস্থানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অপর একজন শহীদ আবদুল গফুর নাকি মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গেছেন বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রথম সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাত সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধা রত্নপুর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামে। ওই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীন ব্যক্তিসহ অন্তত ২শ মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনি কথা বলে জানতে পেরেছেন যে, গফুর নামে কোন মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নেই। গফুর নামে এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের আগেই কলেরায় মারা গেছেন।
অপরদিকে সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম সম্মুখযুদ্ধে গৌরনদীর সাউদের খালপাড় নামক এলাকায় বসে শহীদ হওয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা না ঠৈ গ্রামের সৈয়দ আবুল হাসেমের কবরস্থান সরকারিভাবে বাঁধাই করার তালিকায় স্থান পায়নি। অথচ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ডাকাতের হামলায় নিহত বাটাজোর গ্রামের একজনের সরকারিভাবে কবরস্থান বাঁধাই করার তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গৌরনদী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।