তাবলিগ জামাত; বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের ঈমান, আমল ও নৈতিক উন্নতির স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।তবে নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই অরাজনৈতিক সংগঠনটির অভ্যন্তরে অস্থিরতা বিরাজ করছে।প্রতিষ্ঠা ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দীনকে বাদ দিয়ে তাবলিগ জামাতের নিয়ন্ত্রন নিতে চাচ্ছে পাকিস্তানের রাইভেন্ড।নেতৃত্ব নিয়ে এই বিরোধের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব মুসলমানের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জমায়েত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায়।বাংলাদেশে তাবলিগ সাথীদের মধ্যে বিরোধের সুযোগ নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। পরিকল্পনা করছে নাশকতারও।
গোয়েন্দাসূত্রে জানা গেছে, দিল্লির নিজামুদ্দিন মার্কাজ বিরোধী মুরব্বীদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশে প্রচারনায় নেমেছেন পাকিস্তানের রাইভেন্ড মার্কাজের আলেম ও মুরুব্বীরা। তাদের সাথে যোগ হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করে নিজেদের প্রচারনা চালাচ্ছেন এবং ফতোয়া দিচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বরিশাল বিভাগের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত জেলার গৌরনদীকে বেছে নেয় তারা। মুফতি নূরুল্লাহ ও মুফতি মোজাম্মেল সাহেবের নেতৃত্বে গৌরনদীতে গনজমায়েত করতে চেয়েছেন তারা। কিন্তু সেখানে নাশকতার পরিকল্পনা করছে জামায়াত শিবির ক্যাডাররা; এমন তথ্য রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। তাই গৌরনদীতে কোন ধরনের অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
ফলে গৌরনদীতে ব্যার্থ হয়ে বরিশাল মহানগর হেফাজতে ইসলামীর আমীর ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুবের সাথে যোগাযোগ করেন পাকিস্তান মার্কাজের মুরব্বীরা। ওবায়দুর রহমান মাহবুবের সহযোগিতায় শুক্রবার মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় ‘ওয়াহাবি জোর’ নামে একটি অণুষ্ঠান হওয়ার কথা রয়েছে। সকাল থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে রাইভেন্ড মার্কাজ অনুসারী তাবলিগ জামাতের মুরব্বী, সাথী এবং মাদ্রাসার ছাত্ররা অংশ নিবেন বলে জানা গেছে। তবে এখানেও নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছে না প্রশাসন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশকে অস্থিতিশীল করতে বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে জামায়াত শিবির। কারন জামায়াতে ইসলামী বরাবরই তাবলিগ জামাত বিরোধী। তাই এক ঢিলে দুই পাখি শিকারে নামতে পারে জামায়াত ক্যাডাররা। বরিশাল আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, মাহমুদিয়া মাদ্রাসা এলাকায় নজরদাবি বাড়ানো হয়েছে। কঠোর অবস্থানে রয়েছেন তারাও।
তাবলিগ জামাতে রিরোধের নেপথ্যেঃ ১৯২২ সালে ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দীনে তাবলিগ জামাতের আত্মপ্রকাশ ঘটে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর নেতৃত্বে। তাবলিগ জামাতের মূল মার্কাজ স্থাপিত হয় সেখানেই। তবে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়। ধর্মের ভিত্তিতে এভাবে দেশ ভাগ হওয়ার বিষয়টি তৎকালীন আলেমদের বড় একটি দল সমর্থন করেননি।দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন শাইখুল হাদিস সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) সহ অধিকাংশ দেওবন্দি আলেম দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘোরবিরোধী ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পর বেশিরভাগ মুসলমান পাকিস্তান চলে যাওয়ায় অনেকের ইচ্ছা ছিল তাবলিগের মূল মার্কাজ ভারত থেকে পাকিস্তান সরিয়ে নেয়ার।
এ উদ্দেশে লাহোরের রাইভেন্ডে বড় জায়গা দেখে মার্কাজও বানানো হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তাবলিগ জামাতের তৎকালীন হযরতজি মাওলানা ইউসুফ (রহ.) ।পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারাও তাকে এ বিষয়ে অনেক অনুরোধ করেছিলেন।তবে এ বিষয়ে তিনি ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সঙ্গে পরামর্শ করলে, সবাই তাবলিগের মূল মার্কাজ পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার বিপক্ষে মত দেন। ফলে তাবলিগের মূল মার্কাজ নিজামুদ্দীনেই থেকে যায়। ওই বৈঠকে সাইয়্যেদ হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.), শাইখুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.) ও মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী (রহ.) সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।তাবলিগের ইতিহাসে ঐতিহাসিক এ রায় ‘তিন আকাবিরের সিদ্ধান্ত’ বলে প্রসিদ্ধ।এরপর থেকে মূল মার্কাজ দিল্লির নিজামুদ্দীন এবং সহযোগি মার্কাজ পাকিস্তানের রাইভেন্ড ও বাংলাদেশের কাকরাইলের মাধ্যে তাবলিগের মেহনত সারা বিশ্বে সমানতালে চলছিল। তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশে।
বিশ্বব্যাপী পরিচালিত এ কাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিজামুদ্দীন বা টঙ্গী ইজতেমায় নেয়া হয়।তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সূচনালগ্নে মার্কাজ স্থানান্তরিত করতে না পারলেও, তারা কিন্তু থেকে থাকেনি। ১৯৯৫ সালে তৃতীয় হজরতজি মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) ইন্তেকালের সময় তিনজনের হাতে তাবলিগের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এরা হলেন- মাওলানা ইজহারুল হাসান, মাওলানা জুবাইরুল হাসান ও মাওলানা সাদ কান্ধলভি।২০১৪ মাওলানা জুবাইরুল হাসান (রহ.) ইন্তেকালের পর একক জিম্মাদার হিসেবে মাওলানা সাদ রয়েছেন।কিন্তু নিজামুদ্দীন মার্কাজকে যারা শুরু থেকেই মানতে পারেননি. তারা মাওলানাকে বিভিন্ন ধরনের অসহযোগিতা শুরু করেন।
যার বেশিরভাগই পাকিস্তান রাইভেন্ড মার্কাজের।এরই মধ্যে ২০১৫ সালে রাইভেন্ড ইজতেমায় পাকিস্তানের সাথীরা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কয়েকজন মুরব্বির একটি তালিকা পেশ করে বলল, ‘এখন থেকে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হবে’। তারা এর নাম দেন ‘আলমী শূরা’। বিশ্বের অন্য দেশের মুরব্বি ও শূরাদের সঙ্গে পরামর্শ এবং মতামত গ্রহণ ছাড়াই তারা এ কমিটি ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশের শূরাদের আপত্তির কারণে সফল হতে পারেনি। বিষয়টির সমাধান বা পর্যালোচনার জন্য সামনে হজ ও টঙ্গীর ইজতেমা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শূরারা হজ থেকেই আলাদা হয়ে যান।
প্রতি বছর হজের সময় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুরব্বিরা একসঙ্গে থাকতেন। কিন্তু ২০১৬ থেকে পাকিস্তান ঘোষণা দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। এরপর তারা বিভিন্ন দেশে সফর করে নিজামুদ্দীনের বিরোধিতা করা শুরু করেন। তাদের গঠিত আলমী শূরা মেনে নেয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। তখন থেকে অনেক দেশে বিশৃঙ্খলা শুরু হলেও তেমন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালে নিজামুদ্দীন থেকে দু’জন মুরব্বি আলমী শূরার সমর্থনে বেরিয়ে যান। এরপর থেকেই অস্থিরতা দৃশ্যমান হয়#