অনলাইন ডেস্ক: মেঘনা যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। জেলেরা সারাদিন জাল ফেলেও দু-চারটির বেশি ইলিশ পাচ্ছেন না। ১ জুন থেকে শুরু হয়েছে ইলিশের ভরা মৌসুম। কিন্তু সাগর ও নদী থেকে জেলেরা এখনও ফিরছেন বিষণ্ণ মুখে। যেন বন্ধ্যা হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ মেঘনা ও বরগুনা-পটুয়াখালী সাগর মোহনা। ধলপহরে উঠে জেলেরা মেঘনা ও সাগর মোহনায় চাদরের মতো বিছিয়ে দেন জাল। কিন্তু দেখা নেই ইলিশের ।
মৌসুম শুরুর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ইলিশ মিলছে না বরিশালের বদরপুর অংশ থেকে ভোলার চরনিজাম পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ মেঘনার বুকে। গত শুক্রবার প্রায় ১৬ ঘণ্টায় দু’বার জাল ফেলে মাত্র চারটি ইলিশ পেয়েছেন হিজলাসংলগ্ন মেঘনার বালুরঘাট মাছঘাটের জেলে শওকত হোসেন। ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ওই দুটি ইলিশের নিলামে দাম ওঠে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। শওকত হোসেন গতকাল শনিবার জানান, গত দু’দিনে চারজন মানুষের খাওয়া খরচই হয়ে গেছে হাজার টাকার মতো। এমন অবস্থা এখন বেশিরভাগ জেলের। ইলিশ ধরা পড়ছে না শুনে জেলেরাও মেঘনায় নামছেন না।
চাঁদপুরের দক্ষিণে নীলকমলের শেষ সীমান্তে বিশাল মেঘনার বরিশাল অংশের শুরু বঙ্গেরচর থেকে। ভোলার মনপুরা উপজেলার চরনিজামে গিয়ে মেঘনা মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। দীর্ঘ ওই ১০০ কিলোমিটার মেঘনা গভীরতা ও প্রশস্ততায় সবচেয়ে বড়। এই এলাকা বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুরের হাইমচর, নোয়াখালীর হাতিয়ার হাজার হাজার ইলিশ জেলের বিচরণভূমি। এ এলাকায় মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক মাছঘাট। জেলেদের অভিযোগ, মূলত প্রভাবশালী মাছঘাট মালিকদের কারণেই মেঘনা এখন ইলিশশূন্য।
মেঘনার চরকিল্লা, বালুর ঘাটসহ প্রায় এক ডজন মাছঘাটের আড়তদার বরিশালের হিজলা উপজেলার নজরুল ইসলাম মিলন জানান, ব্যবসায়িক সম্মান রক্ষার জন্য লোকসান দিয়ে তিনি মাছঘাটগুলো চালু রেখেছেন। নচোকাঠি মাছঘাটের আড়তদার রাশেদ বেপারী জানান, ইলিশ ধরা না পড়ায় জেলেরা মেঘনায় নামতে চান না। মৌসুমের শুরু থেকেই মেঘনায় চলছে ইলিশের আকাল। মেঘনার জেলে নুরুল ইসলাম ও লতিফ রাঢ়ী জানান, জেলেরা ধারদেনা করে দিন কাটাচ্ছেন।
বরিশালের পোর্টরোড ইলিশ মোকামের আড়তদার জহির সিকদার জানান, বরিশাল মোকামে বর্তমানে গত বছরের তুলনায় তিন ভাগের এক ভাগ ইলিশ আসছে।
এ কারণে দামও এখন আকাশচুম্বী। জহির সিকদার বলেন, বর্তমানে এক কেজি সাইজের ইলিশ পাইকারি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি এক হাজার ৫০০ টাকা দরে, যা গত বছর বর্তমান সময়ে ছিল এক হাজার থেকে এক হাজার দুইশ’ টাকা। বরিশাল জেলা মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল জানান, গত বছর ইলিশ মৌসুমের শুরুতে প্রতিদিন তিন-চারশ’ মণ ইলিশ আসত তার আড়তে। এ বছর মৌসুমের শুরু থেকে ৮-১০ মণের বেশি ইলিশ আসছে না।
ভোলার সদরে রামদাসপুর থেকে দক্ষিণে মনপুরার চরনিজাম পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার মেঘনাতীরে শতাধিক মাছঘাটের জেলেরা এখন অলস দিন কাটাচ্ছেন। ভোলার খালগোড়া মাছঘাটের আড়তদার আরিফ হোসেন জানান, শুধু ইলিশ কেন; পোমা, আইড়সহ বর্ষা মৌসুমে কোনো মাছই তেমন মিলছে না মেঘনায়। মনপুরার জনতার বাজার মাছঘাটের ব্যবসায়ী আমির হোসেন জানান, জেলেদের খোরপোশ দিয়ে রাখতে হচ্ছে ঘাট মালিকদের।
চরফ্যাসনের অন্যতম ইলিশ মোকাম চরপাতিকার জেলে হারুন মহাজন জানান, মেঘনায় তো ইলিশ মিলছেই না; বরং যেসব ট্রলার সাগরে যাচ্ছে, তারাও খরচের অর্ধেক টাকার মাছ নিয়েও ফিরছে না। ফলে সাগরগামী জেলেরাও ঘরে বসে দাদনের টাকায় দিনযাপন করছেন।
দুর্দিন যাচ্ছে বরগুনার ২৫ হাজার জেলে পরিবারে। দক্ষিণের প্রধান সরকারি ইলিশ মোকাম পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার মো. আব্বাস উদ্দিন ও সেলিম খান জানান, গভীর সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেরা মোহনায় ইলিশ ধরছেন। কিন্তু মোহনায় মৌসুমের শুরুতে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। আব্বাস উদ্দিন ও সেলিম খান বলেন, শুক্রবার পাথরঘাটার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ৬৪টি আড়তে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মণ ইলিশ এসেছে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আজহারুল ইসলাম বলেন, সাগর মোহনা থেকে বিস্তীর্ণ মেঘনায় অসংখ্য ডুবোচর জেগেছে। ফলে ইলিশের ঝাঁক ডুবোচরে বাধা পেয়ে আবার সাগরে ফিরে যাচ্ছে।
যে কারণে মেঘনায় ইলিশ মিলছে না। বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, বর্ষা আসতে দেরি হওয়ায় ইলিশ মিলছে না সাগর ও নদীতে।