বরিশালে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে তালা, বাইরে আড্ডা

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

বরিশালের মুলাদী উপজেলার চরকালেখান ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ ঘরে তালা ঝুলছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রকৃত ভূমিহীনদের বরাদ্দ না দেওয়ায় ঘরগুলো খালি পড়ে আছে।

শুধু চরকালেখান ইউনিয়নের আশ্রয়ণ প্রকল্পই নয়, উপজেলার অধিকাংশ আশ্রয়ণের ঘর খালি পড়ে আছে। এসব ঘর কবে ব্যবহার করা হবে, তা জানেন না কেউ।

জানা যায়, জমি নাই, ঘর নাই প্রকল্পের আওতায় মুলাদী উপজেলায় সরকারি জমিতে ৩৮০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

ভূমিহীনদের ২ শতাংশ জমিসহ ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩৬০ জনকে জমির দলিলসহ ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৫০ জনের নামজারি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে ভূমিহীন প্রত্যয়ন নেওয়া হয়েছে।

অনেকের জমি, বাড়িঘর থাকা সত্ত্বেও সরকারি জমিসহ ঘর বরাদ্দ নিয়েছেন। যাঁরা ঘর নিয়েছেন তাঁরা তথ্য গোপন করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ইউপি চেয়ারম্যানেরা।

অপরদিকে যাঁরা ঘর পাননি তাঁদের অভিযোগ, চেয়ারম্যানরা তাঁদের নিজস্ব লোকদের ঘর বরাদ্দ দেওয়ায় প্রকৃত ভূমিহীনেরা বঞ্চিত হয়েছেন।

অনেক ক্ষেত্রে পিতা-মাতার জমি থাকায় ছেলেমেয়েকে ভূমিহীন হিসেবে উপহারের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এই ছেলেমেয়েরা বাবার বাড়িতে থাকায় উপহারের ঘরে যাওয়ার চিন্তা করছেন না। আবার মা-বাবার অবর্তমানে জমির মালিক হলে উপহারের ঘর কী করবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

উপজেলার চরকালেখান ইউনিয়ন মৃধারহাটের উত্তর পাড়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৮২টি ঘর নির্মাণ করা হয়। সব ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সেখানে মাত্র ৮টি ঘরে সুবিধাভোগীরা বাস করছেন। বাকিরা আসবেন কিনা তা জানেন না সেখানের বাসিন্দারা।

যাঁরা ঘরে থাকেন তাঁদের দাবি, প্রয়োজন থাকলে ঘর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতেন। প্রয়োজন ছাড়াই ঘর নিয়েছেন, তাই এসব ঘরে আসতে চাইছেন না। উপজেলার সফিপুর ইউনিয়ন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬৫টি ঘরের মধ্যে থাকেন মাত্র ২৩ জন।

উপজেলার চরকালেখান ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আলতাফ হাওলাদারের ছেলে হান্নান হাওলাদার বলেন, ৮২টি ঘরের মধ্যে আমরা ৮ জন বাস করছি।

এই ৮টি ঘরেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। বাকিরা আসবেন কিনা জানা নাই। ঘরে লোকজন না থাকায় যুবকেরা এসে বারান্দায় বসে বিড়ি, সিগারেট খায়। আমরা কিছু বলতে পারি না।

উপজেলার বাটামারা ইউনিয়নের চরবাটামারা গ্রামের মৃত ফেরদৌস মোল্লার স্ত্রী মাহমুদা বেগম বলেন, স্বামীর ৬ শতাংশ জমি ছিল।

জয়ন্তী নদীর ভাঙনে তা বিলীন হয়ে গেছে। এখন নদীর পাড়ে আধা শতাংশ জমিতে ভাঙা ঘরে বাস করছি। যেকোনো সময় নদীভাঙনে ঘরটি বিলীন হয়ে যেতে পারে। সরকার ভূমিহীনদের ঘর দিয়েছে শুনেছি। একটি ঘর পেলে থাকার জায়গা হতো।

বাটামারা ইউনিয়নের আলীমাবাদ গ্রামের হোসেন হাওলাদারের স্ত্রী রানু বেগম জানান, ২০২১ সালে অক্টোবর মাসে আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়েছি।

বৃদ্ধ স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। জমি না থাকায় ঘর করতে পারছি না। তাই নদীর পাড়ে কয়েকটি টিন দিয়ে ছাপরা তুলে বাস করছি।

চরকালেখান ইউপি সদস্য মো. রাশেদুজ্জামান মৃধা জানান, গাছুয়া ইউনিয়নের পুনিল তালুকদারের ছেলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

বর্তমানে তিনি অন্যের বাড়িতে থাকছেন। তাঁর একটি ঘরের প্রয়োজন। কিন্তু তালিকা থেকে তাঁর নাম বাদ পড়ায় ঘর বরাদ্দ পাননি।

এ ছাড়া হিজলার নদীভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে সুমন ভক্ত ও তাঁর স্ত্রী রিতা ভক্ত চরকালেখান গ্রামে থাকেন। প্রকৃত ভূমিহীন হিসেবে তাঁদের ঘর দেওয়ার আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু ঘর না পাওয়ায় নতুন করে তালিকা দেওয়া হয়েছে।

চরকালেখান ইউপি চেয়ারম্যান মো. মিরাজুল ইসলাম সরদার জানান, পূর্ববর্তী চেয়ারম্যানের তালিকা অনুসারে উপহারের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

তাই জমি থাকা সত্ত্বেও কেউ উপহারের ঘর নিয়েছেন কি না তা জানা নেই। তবে কারও অভিযোগ থাকলে তদন্ত করে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করা হবে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. হানিফ শিকদার জানান, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ভূমিহীনদের নাম প্রস্তাব করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।

ইউপি চেয়ারম্যানদের তালিকা অনুসারে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পিতা জীবিত থাকায় সন্তানকে ভূমিহীন দেখিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

তাই বরাদ্দ দেওয়ার পরেও কিছু ঘরে লোক থাকছেন না। তবে জমি-বাড়ি ও ঘর থাকা সত্ত্বেও কেউ বরাদ্দ পেয়ে থাকলে হালনাগাদ করা হবে। প্রকৃত ভূমিহীনদের নতুন তালিকা করে জমি ও ঘর বরাদ্দ দেওয়া প্রক্রিয়া শুরু হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ হোসাইনী বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের ভূমিহীন প্রত্যয়ন সাপেক্ষে ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

 

এসব ঘর হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। যেসব ঘর খালি থাকবে তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হবে এবং যাদের প্রয়োজন তাদের নামে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হবে।