নির্বাচনের বছরে আসছে নতুন বাজেট। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা আসন্ন বাজেট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন। তুলে ধরছেন নিজেদের দাবি-দাওয়া। অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এসব দাবি-দাওয়া বিবেচনারও আশ্বাস দিচ্ছেন।
তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনরা বলছেন, নির্বাচনী বাজেট মানে সবাইকে খুশি করার চেষ্টা। এরপরও স্থবির বিনিয়োগ সচল এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে আমদানি ব্যয় কমিয়ে রফতানি বৃদ্ধিতে যেন ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ থাকতে হবে।
শুধু লোক দেখানো পদক্ষেপের কথা বললেই হবে না
একই ধরনের পরামর্শ দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বাংলাদেশি প্রতিনিধিরাও। সম্প্রতি প্রকাশিত আলাদা প্রতিবেদনে সংস্থা দুটি ব্যাংকিং খাতসহ সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এবার বাজেট প্রণয়নে জনবান্ধব বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। উন্নয়ন খাতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এছাড়া নতুন করে কর না বাড়িয়ে এর আওতা ও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, সর্বজনীন পেনশন ইন্স্যুরেন্স স্কিমের রূপরেখা প্রণয়ন, প্রায় এক কোটি মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বাজেটে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুত প্রকল্পগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব উন্নয়ন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে পারেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কর্মসংস্থানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত
এদিকে, আসন্ন বাজেট নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা চলছে। এসব আলোচনায় ব্যবসায়ীরা বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, ব্যক্তিপর্যায়ে ন্যূনতম করহার কমানো, সারচার্জে ছাড় ও করপোরেট কর কমানোর কথা বলছেন। অন্যদিকে বিশিষ্টজনরা বলছেন, বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার বাড়ানোর বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেয়া উচিত।
তারা আরও বলছেন, প্রতি বছর অনেকটা লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করা হয় না। এবার যেন সেটা না হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাজেটে শুধু লোক দেখানো পদক্ষেপের কথা বললেই হবে না, করে দেখাতে হবে। এখন মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা জরুরি। প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট কমিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার।
‘ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা চলছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। বাজেটে এর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঘোষণা করা উচিত।’
প্রতি বছরই বাজেটের আকার বাড়ছে কিন্তু বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেটের বাস্তবায়নের হার ছিল ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এটা কমে দাঁড়ায় ৭২ শতাংশে। কাজেই শুধু বরাদ্দ রাখলে হবে না। বাস্তবায়ন কতটুকু হলো সেটাই উল্লেখযোগ্য। বাস্তবায়নহীন বরাদ্দ বাড়ানো আমি অর্থহীন বলে মনে করি।’
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, ‘এবারের বাজেটে কর্মসংস্থানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। এজন্য ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ বাজেট হতে হবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবান্ধব।’
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। তাই বাজেটে বড় পরিবর্তন আশা করছি না। তবে বাজেটে যে ধরনের সংস্কার হওয়া দরকার, গত কয়েক বছর পর্যন্ত তা হয়নি। সে কারণে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়েনি। জিডিপির অনুপাতে এখনও দেশে কর আদায় নয় দশমিক পাঁচ শতাংশ। এ পরিমাণ কর আদায়ে উচ্চ-মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশের তালিকায় যাওয়া যাবে না। এরপরও এবারের বাজেটে কিছু সংস্কার আনা উচিত।’
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘অর্থনীতিতে শেয়ারবাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতকে এগিয়ে নিতে হলে বাজেটে প্রণোদনা দিতে হবে।’
‘দেশে বেকারের হার বেড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন শ্রম বাজারে যুক্ত হচ্ছে মানুষ। কিন্তু কর্মসংস্থান সে হারে বাড়ছে না। উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এবারের বাজেটে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানোরও পদক্ষেপ রাখা উচিত।’
সাবেক ব্যাংকার মামুন রশিদ বলেন, ‘প্রতি বছর দেশে ভোগব্যয় বাড়ছে। এর মানে হলো দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। ফলে বিদেশিরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
প্রসঙ্গত, গত অর্থবছরে (২০১৭-১৮) চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৭ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হতে পারে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। এর আগে ১০ম জাতীয় সংসদের ১৬তম অধিবেশন (যা বাজেট অধিবেশন নামেই পরিচিত) ডাকবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
এ বছরের ডিসেম্বরেই হতে পারে ১১তম জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন। তাই এবারের বাজেট হবে সরকারের নির্বাচনী বাজেট, মানুষকে খুশি করার বাজেট।