পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণকে এমনভাবে সেবা দিতে হবে যেন তারা পুলিশকে তাদের জীবন রক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকের অপব্যবহার রোধ, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ রোধে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি, সবসময় সতর্ক থাকা দরকার। আগ্নেয়াস্ত্র, মাদকের অপব্যবহার, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ঘটনা যেন আর না ঘটতে পারে, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
মঙ্গলবার (২১ জুন) বাংলাদেশ পুলিশের পাঁচটি বিশেষ কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তিনি।
অনুষ্ঠানে গণভবনের সঙ্গে ভার্চুয়ালি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, পদ্মা সেতু উত্তর থানা- মুন্সীগঞ্জ, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) মহিলা পুলিশ ব্যারাক, ময়মনসিংহ পুলিশ হাসপাতাল এবং পিরোজপুর পুলিশ লাইন্স যুক্ত ছিল।
দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রাখতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযানে সফলতা অর্জন করেছে পুলিশ বাহিনী। অব্যাহতভাবে মাদক নির্মূল, সাইবার ক্রাইম/গুজব, মানি লন্ডারিং, অস্ত্র চোরাকারবার, মানব পাচার রোধসহ নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রেখে চলছে। তবে এগুলো যেন আর না ঘটে সেজন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। কেননা দেশে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকলেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারবো।
পুলিশকে আরও জনবান্ধব হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭২ সালের ৮ মে সারদা পুলিশ একাডেমিতে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আপনারা জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতায় এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন। আমি দুনিয়ার অনেক জায়গায় ঘুরেছি। গ্রেট ব্রিটেনে দেখেছি একজন সিপাহীকেও জনসাধারণ শ্রদ্ধা করে। কোনো পুলিশ কর্মচারীকে দেখলে তারা আশ্রয় নেওয়ার জন্য তার কাছে দৌড়ে যায়। তারা মনে করে পুলিশ তাদের সহায়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের পুলিশ বাহিনকেও সেভাবেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। যেন জনগণ মনে করে যে, তাদের জীবন রক্ষায়, সম্মান রক্ষায় পুলিশই হচ্ছে শেষ ভরসা। পুলিশের কাছে তারা যেন সেই আশ্রয়টা পায়, সেই ভরসার স্থান হিসেবে পুলিশকে জনগণের সামনে নিজেকে সেভাবে তুলে ধরতে হবে। সেটাই আপনারা করবেন। জাতির পিতার এই নির্দেশ আপনারা মেনে চলবেন, সেটাই আমি চাই।
তিনি বলেন, অপরাধের ধরন পাল্টাচ্ছে, কেননা এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও এখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কাজেই এর সঙ্গে মোকাবিলা করে আমাদের পুলিশ বাহিনীও যেন চলতে পারে এবং তদন্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে সরকার সে ব্যবস্থা নিয়েছে। সরকার এখন অনলাইনে জিডির ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ডিজিটাল ডিভাইসের সাহায্যে অনলাইনে পুলিশি সেবার বন্দোবস্তও করেছে। কাজেই ঘরে বসেই জনগণ এই সেবা পাবেন এবং তাদের অভিযোগের সর্বশেষ অবস্থা জানতে পারবেন।
প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে আসায় পুলিশকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশ তাহলে আরও জনবান্ধব হবে এবং পুলিশের সেবাটা আরও বেশি করে জনগণ পাবে। এ সময় করোনা মোকাবিলায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করে এ কাজে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও সমানতালে এগিয়ে এসেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার পুলিশে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সার্ভিস ডেস্ক চালু করেছে এবং বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার কথা স্মরণ করে সেখানে আত্মাহুতি দানকারী দুই পুলিশ সদস্যের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতায় সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি এবং র্যাবের কম্বাইন্ড অপারেশনের মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে সমস্যার সমাধানে সরকারের সাফল্যের পুনরুল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এরপর দেশে সে ধরনের আর কোনো বড় ঘটনা ঘটতে পারেনি। যেখানেই যে ঘটনা ঘটেছে পুলিশ সদস্যরা জীবন দিয়ে হলেও তা প্রতিহত করেছে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করেছে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, পুলিশ সদস্যদের হত্যা, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের প্রসঙ্গ টেনে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সদস্যদের সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেন। এছাড়াও মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা বিধানেও পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও পুলিশ বাহিনীর সাফল্যজনক সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয় উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে ‘পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা’ এবং পুলিশ সদস্যদের জন্য ‘কমিউনিটি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠাসহ তার সরকারের সময়ে পুলিশ বাহিনীর উন্নয়নে এবং কল্যাণে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, গত সাড়ে ১৩ বছর পুলিশের উন্নয়নে নিরলস কাজ করছি। পুলিশে মোট ৮২ হাজার ৫৮৩টি নতুন পদ সৃজন করেছি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল-ট্যুরিস্ট-নৌ ইউনিট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, অ্যান্টি-টেররিজম ও কাউন্টার-টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, রংপুর ও ময়মনসিংহে রেঞ্জ, রংপুর এবং গাজীপুরে মেট্রোপলিটন পুলিশ, রংপুরে আরআরএফ এবং সিআইডি’তে সাইবার পুলিশ সেন্টার গঠন করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার নারী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ ২টি সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, এয়ারপোর্টে একটি ও কক্সবাজারে ২টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং র্যাবের জন্য ৩টি ব্যাটালিয়ন, ৩০টি ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, ৬২টি থানা, ৯৫টি তদন্ত কেন্দ্র এবং ১টি ফাঁড়ি এবং জাতীয় জরুরি সেবায় ‘৯৯৯’ ইউনিট গঠন করেছে। পাশাপাশি, আকাশপথে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পুলিশের জন্য হেলিকপ্টার ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সবশেষে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি এবং এই সেতু তৈরিতে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে মোকাবিলা করার মাধ্যমে তার সরকার দেশের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন বক্তব্য দেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।