দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী রাবনাবাদ চ্যানেলে নির্মাণাধীন পায়রা বন্দর হতে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের গভীর সমুদ্রবন্দর। দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর এটি। বন্দর থেকে ৭৫ কিলোমিটার গভীরে ১০ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেলসহ এই বন্দরকে কেন্দ্র করে অবকাঠামো উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দরের কাজ সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পায়রা সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটা সমুদ্রবন্দর এক দিনে হয় না। ১৩০ বছরের পুরনো দেশের প্রধান চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৩ সালে ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছর আগে দেশে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর দেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর উপকূলে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। ইতিমধ্যে বন্দরের স্বল্প মেয়াদের কাজ শেষ হয়েছে। এখন মধ্য মেয়াদি কাজ চলছে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ (পিপিএ) সূত্র জানায়, এই বন্দরকে পরিকল্পিত এবং একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক মানের সমুদ্রবন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য বন্দরের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়ালিংফোর্ডের মাধ্যমে পায়রা বন্দরের জন্য একটি কনসেপচ্যুয়াল মাস্টার প্লান প্রস্তুত করা হয়। ওই মাস্টার প্লানে পূর্ণাঙ্গ পায়রা বন্দরের উন্নয়ন কাজকে ১৯টি কম্পোনেন্টে (উপাদান) বিভাজন করা হয়।
এর মধ্যে ১২টি কম্পোনেন্ট পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ সরকারি অথবা অন্যান্য দেশের অর্থায়নে (জি টু জি) অর্থায়নে কিংবা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাস্তবায়ন করবে। অপর ৭টি কম্পোনেন্ট স্ব-স্ব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। স্বল্প মেয়াদে বন্দরের কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে কলাপাড়ার টিয়াখালী এলাকায় ১৬ একর জমির ওপর ব্যাকআপ ফেসিলিটিজ এরিয়া এবং ৩২ একর জমিতে কোয়ার্টার নির্মাণের কাজ শুরু হয়।
ইতিমধ্যে ব্যাকআপ ফেসিলিটিজ এরিয়ায় নিরাপত্তা ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ১ হাজার কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন, ভিএইচএফ টাওয়ার, ওয়ার হাউস, মসজিদ, মাল্টিপারপাস ভবন, স্টাফ ডরমেটরি, সার্ভিস জেটি, সংযোগ নদীর ড্রেজিং ও মার্কিং বয়া স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর পরিচালনায় অপরিহার্য জলযান পাইলট ভেসেল, হেভি ডিউটি স্পিডবোট, টাগ বোট, বয়া লেইং ভেসেল এবং জরিপ বোট নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ভূমি অধিগ্রহণের কারণে বাস্তুহারা ৩ হাজার ৫০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য আনুষঙ্গিক সুবিধাদিসহ ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহনির্মাণ এবং বন্দর থেকে বরিশাল-কুয়াকাটা সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ দশমিক ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ শেখ হাসিনা ফোর লেন সড়ক নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। মধ্য মেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাবলিক-প্রাইভেট চুক্তিতে (পিপিপি) আরও ৪টি প্রকল্প ড্রাই বাল্ক/কোল টার্মিনাল, ক্যাপিটাল অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং, জিওবি টার্মিনাল এবং ভারতীয় ঋণ সহায়তায় মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম দফায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রাই বাল্ক/ কোল টার্মিনাল নির্মাণ কাজের টেন্ডার হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে শিগগিরই রাবনাবাদ চ্যানেলের তীরে ১০০ একর জায়গায় বেসরকারি অর্থায়নে ৭০০ মিটার জেটিসহ পিপিপি পদ্ধতিতে পায়রা বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হতে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। পায়রা বন্দর থেকে খালাসকৃত পণ্য দেশের অন্যত্র পরিবহনের লক্ষ্যে রাবনাবাদ চ্যানেল-সংলগ্ন এলাকায় ন্যূনতম অবকাঠামো সংযোগ সড়ক, আন্ধারমানিক নদীর ওপর সেতু ও ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জেটিসহ একটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৩ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের জিওবি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ভারত সরকারের তৃতীয় পর্বের ঋণে অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়ক ও ১ হাজার ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জেটিসহ একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে ৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে।
জাতীয় অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তর্জাতিক ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডে নুল’ এর সঙ্গে গত ১৪ জানুয়ারি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তি করেছে। ৮ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ চলছে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনায় একটি পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ডিটেইলড মাস্টার প্লান অনুসরণ করে আরও ৪টি টার্মিনাল বন্দর কর্তৃপক্ষ পিপিপি এবং জি টু জি পদ্ধতিতে ২০২৫ সালের মধ্যে নির্মাণ করবে।
এ ছাড়াও পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত রেললাইন, ডকইয়ার্ড, ইকোট্যুরিজম, এলএনজি টার্মিনাল, লিক্যুইড বাল্ক টার্মিনালসহ অন্যান্য সুবিধা ও অবকাঠামো গড়ে উঠবে।
এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০২৫ সালের মধ্যে পায়রা সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে আশা বন্দর কর্তৃপক্ষের।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. নিজামউদ্দিন বলেন, পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করেছে। পায়রা বন্দর পূর্ণাঙ্গ হলে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব অবদান রাখতে পারবে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন চালু হলে দেশের উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত তৃতীয় অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠা পাবে।
-বিডি প্রতিদিন