পা হারানো সেই নিপার পাশে বাকরুদ্ধ মা-বাবা

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

পরদিন স্কুলে দোল উৎসবের ছুটি। তাই মাকে বলে এসেছিল, ক্লাস শেষে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করবে। খেলা তো হয়ইনি; এখনও ফিরতে পারেনি বাড়িতেও। জ্ঞান ফেরার পর থেকে চার দিন ধরে যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিপা বারবার বলছে, ‘সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে কেন তার পা কেটে ফেলতে হলো? কী অপরাধ তার? তার পা কি আর জোড়া লাগানো যাবে?’

হাসপাতালের বিছানায় মেয়ের পাশে বসে বাকরুদ্ধ বাবা-মা নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না তারা। নিপার মা মুসলিমা বেগম বলেন, ‘মেয়েটা আমার খুব মেধাবী। তার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু কপালে এ কী ঘটে গেল!’ কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।

মেফতাহুল জান্নাত নিপা (১১) যশোরের শার্শা উপজেলার বুরুজবাগান পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী। গত বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর এ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রথম হয়েছিল সে। বুধবার সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে পল্লী বিদ্যুতের একটি পিকআপ তাদের বহনকারী স্কুলভ্যানকে চাপা দিলে গুরুতর আহত হয় নিপাসহ আরও তিন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নিপাকে হাসপাতালে ভর্তির পর তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়।

মেয়ের এমন পরিণতিতে হতবিহ্বল নিপার বাবা স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের শিক্ষক রফিকুল ইসলামও হতাশা আর দুশ্চিন্তায় ভরা চোখে হাসপাতালের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। বললেন, ‘অভাবের সংসার, তবু ইচ্ছা ছিল মেয়েকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করব। এখন একটাই চিন্তা, আদরের মেয়ে আমার এক পায়ে চলবে কীভাবে!’

যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আওয়াল বলেন, নিপার সব ধরনের চিকিৎসার ভার জেলা প্রশাসন বহন করবে।

এদিকে, বুধবারের দুর্ঘটনার পর নিপার বিক্ষুব্ধ সহপাঠী ও এলাকাবাসী পিকআপটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় ও যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে প্রশাসনের আশ্বাসের পর অবরোধ প্রত্যাহার হলেও চার দিনেও ধরা পড়েনি ওই গাড়িচালক। শার্শা থানার ওসি মশিউর রহমান অবশ্য দাবি করেছেন, পিকআপের চালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাকে আটক করতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

পুলিশের এ তৎপরতায় সন্তুষ্ট নন নিপার সহপাঠীরা। গতকাল শনিবার সকালে ফের তারা যশোর-বেনাপোল সড়কের নাভারণে অবরোধ করে। তারা ঘাতক চালককে আটক এবং আহত নিপার উন্নত চিকিৎসা ও চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার সরকারিভাবে বহনের দাবিতে স্লোগান দেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার শান্তিপূর্ণ এ অবরোধে যশোর-বেনাপোল ও যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের দু’পাশে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, পুলিশ আন্তরিক হলে চালককে আটক করা কঠিন কিছু নয়; কিন্তু পুলিশ সেটা করছে না। বুরুজবাগান পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোকাররম হোসেন বলেন, খুব মেধাবী ও বিনয়ী মেয়ে ছিল নিপা। সে এ বিদ্যালয়ে নবীন হলেও অল্পদিনেই সবার নজর কাড়ে। তার করুণ এ পরিণতিতে সবাই ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীরা বড় কর্মসূচি দেওয়ার আগেই অভিযুক্তকে আটক করা হোক।

এদিকে শার্শা থানার ওসি মশিউর রহমান জানান, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে অবিলম্বে অভিযুক্ত পিকআপ চালককে আটকের আশ্বাস দিলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। এখন ওই সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।