ইরাকের রাজধানী বাগদাদে শুক্রবার ভোরে ড্রোন হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় কোনো না লিখে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার ছবি দেন। তিনি এর মাধ্যমে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা তিনিই জানেন। তবে এটা খুব স্পষ্ট যে ট্রাম্প একে যুক্তরাষ্ট্রের বহু কাঙ্খিত বিজয় হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
বিমানবন্দর থেকে গাড়িবহরে যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ( শুধু খামেনির পর ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে পরিচিত কাসেম সোলেইমানি নিহত হননি। তার সঙ্গে নিতহ হয়েছেন ইরাকে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হাশেদ আল-শাবির উপপ্রধান আবু মাহদি আল মুহান্দিস। তিনি সোলেইমানির উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
ইরাকের প্রভাবশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হাশেদ আল-শাবির উপপ্রধান আবু মাহদি আল-মুহান্দিস ইরাকের একজন প্রভাবশালী নেতা। হাশেদের শাখা কাতায়েব হিজবুল্লাহর দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শিয়া মিলিশিয়াদের নিয়ে এই গোষ্ঠীটি গঠিত হলেও পরে অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ইরাকি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছে কাতায়েব। দীর্ঘদিন ধরেই তারা মার্কিন বাহিনীর নিশানায় ছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থনে সবার আগে তাদেরই সিরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। ইরাকে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী করে ২০০৯ সালে কাতায়েব হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয় ওয়াশিংটন।
একই সময়ে হাশেদ আল-শাবির উপপ্রধান আবু মাহদি আল-মুহান্দিসকেও সন্ত্রাসী আখ্যা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৩ সালে কুয়েতে মার্কিন ও ফ্রান্সের দূতাবাসে হামলার জন্য মুহান্দিসের অনুপস্থিতিতেই তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ শাস্তি দেন দেশটির আদালত। কিন্তু সেই শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
কাতায়েব প্রধান মুহান্দিস এক ইরানি নারীকে বিয়ে করে দেশটির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। গত রোববার তাদের ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান হামলায় ২৫ জন যোদ্ধা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে হামলা ও ভাঙচুর তার নেতৃত্বেই হয়েছে বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হচ্ছে।
ইরাকের উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও ছিলেন তিনি। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই মূল উদ্দেশ্য থাকলেও ইসরায়েলের ওপরও নজর রাখছিলেন তারা। ওয়ালস্ট্রিট জানাচ্ছে, ২০১৯ সালের জুনে সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে একটি বাড়িতে বোমা হামলা করে ইসরায়েল। তখন আল-কুদস ফোর্স ইরানি অস্ত্র সিরিয়ায় সরানোর চেষ্টা করছিল।
গত বছরের আগস্টে মুহান্দিস অভিযোগ করেন, তার মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সমন্বিত গোপন অভিযান চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। আজারবাইজান থেকে ড্রোন দিয়ে ইরাকে বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল বলে দাবি করেন তিনি। তার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এই হামলা চালানো হচ্ছে।
প্রকৌশলবিদ্যায় পড়াশোনা শেষে প্রথমে শিয়াভিত্তিক দাওয়া পার্টিতে যোগ দেন মুহান্দিস। ১৯৭৯ সালে তখনকার ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি সীমান্তবর্তী ইরানি শহর আহভাজে পালিয়ে যান। ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি ইরানের অভিজাত বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডসের হয়ে কাজ শুরু করেন।
আল-কুদস ফোর্সেরও সামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন মুহান্দিস। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০০৫ সালে মার্কিন হামলাপরবর্তী প্রথম ইরাকি প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহীম আল-জাফরির নিরাপত্তা উপদেষ্টারও দায়িত্ব পালন করেন। একবার ইরাকের এমপি-ও ছিলেন তিনি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, শুক্রবার ভোরে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালের পাশে দুটো গাড়িতে মার্কিন বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া তিনটি রকেট আঘাত হানে। তখন একটি গাড়িতে ছিলেন সোলেইমানি ও মুহান্দিস। অপরটিতে তাদের নিরাপত্তা দিতে ইরাকের আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
ইরাকে দীর্ঘদিন ধরেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভের পর প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তার কিছুদিনের মাথায় গত রোববার আল শাবির ঘাঁটিতে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিবাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুরের গোষ্ঠীটির সদস্যরা। তার দুই দিনের মাথায় এই হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা তৈরি করবে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
বিবিসি বলছে, ইরানের সশস্ত্র বাহিনীতে জেনারেল কাসেম সোলেইমানি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে দেয়া হতো জাতীয় বীরের সম্মান। তার কুদস্ ফোর্স কাজ করে মূলত বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর ‘বিদেশি শাখা’ হিসেবে। এই বাহিনী জবাবদিহি করে সরাসরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর সুরক্ষায় ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে’ সোলেইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ইরানের হামলা পরিকল্পনা নস্যাৎ করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। বিশ্বের যেখানেই আমাদের নাগরিক ও সম্পদ রয়েছে, তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই যুক্তরাষ্ট্র নেবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতরের দাবি, জেনারেল কাসেম সোলেইমানি দুদিন আগে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাঙচুরের পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছিলেন। যদিও ওই হামলার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে ইরান। এদিকে জেনারেল সোলেইমানি হত্যার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে ৪ শতাংশ।