দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে রায়হানের দেহে মিলল ১১১টি আঘাতের চিহ্ন

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত যুবক রায়হান উদ্দিনের (৩৫) মরদেহ দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এ তদন্তের প্রতিবেদনে তার শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৪টি আঘাতের জখম ছিল গুরুতর। এসব আঘাতের কারণে তার শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয়।

১৫ অক্টোবর রায়হানের মরদেহ পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়ে। এ দফায় রায়হানের ময়নাতদন্তে গঠন করা হয় তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। যার প্রধান করা হয়েছে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান চিকিৎসক মো. শামসুল ইসলাম। তিনি শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘ময়নাতদন্তকালে রায়হান উদ্দিনের শরীরে মোট ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ১৪টি আঘাত গুরুতর ছিল। বাকি ৯৭টি আঘাত ফোলা আকারের জখম রয়েছে। সবগুলো আঘাতই তার মৃত্যুর ২/৪ ঘণ্টা আগে করা হয়েছে। এছাড়া তার ডান হাতের কানিকাসহ দুটি আঙুল ও বাম হাতের অনামিকার নখ উপড়ানো ছিল। আঘাতের কারণেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।’

শনিবার ওই প্রতিবেদনটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত কর্মকর্তার হাতে হস্তান্তর করেন এ চিকিৎসক।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, রায়হানের শরীরে অতিরিক্ত আঘাতের কারণে শরীরের অভ্যন্তরের রগ ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। আঘাতে দেহের মাংস থেঁতলে যায়। রগ ফেটে গিয়ে আন্তঃদেহে রক্তক্ষরণ (ইন্টারনাল ব্লিডিং) হয়। অতিরিক্ত আঘাতে মূর্ছা যান রায়হান। আঘাত করার সময় রায়হানের পেট (স্টমাক) খালি ছিল, সেখানে কেবল এসিডিটি লিকুইড পাওয়া গেছে।

রায়হানের মৃত্যু থানায় মামলা করেন তার স্ত্রী। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করেছে পিবিআই। মঙ্গলবার (১৩ অক্টোবর) রাতেই এই মামলার নথি পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করে এসএমপি। এরপর পিবিআই কর্মকর্তারা বুধবার দুপুরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান এবং ঘটনার আলামত সংগ্রহ করেন। এর পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পিবিআই। পরে পুনরায় ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে তার মরদেহটি নগরের আখালিয়াস্থ নবাবি মসজিদ সংলগ্ন পঞ্চায়েতি গোরস্থানে দাফন করা হয়।

এর আগে গত শনিবার মধ্যরাতে রায়হানকে তুলে নিয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালী থানার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করে পরিবার। সকালে তিনি মারা যান। নির্যাতন করার সময় এক পুলিশের মুঠোফোন থেকে রায়হানের পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে টাকা চাওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা সকালে ফাঁড়ি থেকে হাসপাতালে গিয়ে রায়হানের মরদেহ শনাক্ত করেন।

ঘটনার শুরুতে ওই ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা ছিনতাইকারী সন্দেহে নগরের কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হান নিহত হয়েছেন বলে প্রচার চালান। কিন্তু গণপিটুনির স্থান হিসেবে যে কাস্টঘর এলাকার কথা বলেছিল পুলিশ, সেখানে সিটি করপোরেশনের স্থাপন করা সিসিটিভির ক্যামেরায় ওই সময়ে এমন কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এছাড়া গত শুক্রবার কাস্টঘরের সুইপার গলির চুলাই লাল দাবি করেন, শনিবার রাতে তার বাসা থেকে সুস্থ অবস্থায় রায়হানকে ধরে নিয়ে যায় বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ।

এ ঘটনায় রোববার রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে পুলিশ সদস্যরা নির্যাতন করে তার স্বামীকে হত্যা করেছেন এমন অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন।

মারা যাওয়ার পর রায়হানের শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার হাতের নখও উপড়ানো ছিল। এ ঘটনার পর পুলিশের বিরুদ্ধে হেফাজতে নির্যাতন করে রায়হানকে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। রায়হানের মৃত্যুর জন্য ‘দায়িত্বহীনতার’ দায়ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূইয়াসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করে তাদের পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।

এর মধ্যে এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া মঙ্গলবার সকালে পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে যান। তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। বাকি ৬ জন পুলিশ লাইনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

মামলা দায়েরের ৭ দিন অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি। এতে নিহতের পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও সিলেটের সচেতন নাগরিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তারা বলছেন, ঘটনার মূলহোতা বন্দরবাজার ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ এস আই আকবর হোসেন পালিয়ে গিয়ে থাকলে বাকি অভিযুক্তদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না?

রায়হান হত্যার প্রতিবাদে ও জড়িত পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতারের দাবিতে ষষ্ঠ দিনের মতো শনিবারও বিক্ষোভে উত্তাল ছিল সিলেটের রাজপথ। শনিবার সকাল ও বিকেলে নগরের কোর্ট পয়েন্ট ও শহীদ মিনারের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে দুটি সামাজিক সংগঠন। এ সময় বন্দরবাজার ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ এস আই আকবরকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা।

এ ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিনের মৃত্যু ও নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতাও পায় এসএমপির তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি জানতে পারে, রোববার ভোর ৩টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে রায়হানকে আনা হয় বন্দরবাজার ফাঁড়িতে। সেখানে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সকাল সাড়ে ৬টা ৪০ মিনিটে রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। সেখানে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে মারা যান তিনি।

নিহত রায়হান নগরের আখালিয়ার নেহারীপাড়া এলাকার তৎকালীন বিডিআরের নায়েক মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। রায়হান নগরের রিকাবীবাজার এলাকার একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে চাকরি করতেন। নিহারিপাড়ায় স্ত্রী, ৬ মাস বয়সী মেয়ে, মা ও চাচাকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। পুলিশি নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা পুলিশের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় মামলাটি নিরপেক্ষ কোনো তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে তদন্তের দাবি ছিল পরিবারের।