অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানের জালে এসেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৫ কারওয়ান বাজার এলাকার বর্তমান লাইসেন্স সুপারভাইজার মো. আবদুর রশিদ। ৩০ মে তাঁকে দুদকে হাজির হতে নোটিশ পাঠিয়েছেন সংস্থাটির উপসহকারী পরিচালক ওমর ফারুক।
চিঠিতে আবদুর রশিদকে দুদকে হাজির হওয়ার সময় বেশ কিছু নথিপত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, তাঁর নিজের নামে এবং নির্ভরশীলদের নামে স্থাবর অস্থাবর সম্পদের যাবতীয় নথিপত্র; আয়কর নথি ও রিটার্নের রেকর্ড; স্থাবর অস্থাবর সম্পদ অর্জনের উৎস সংক্রান্ত নথিপত্র এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ও মার্কশিটের মূল কপি।
আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে জাল সনদে চাকরি নেওয়া, প্রতারণা, জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তবে আবদুর রশিদ বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। রাজনৈতিক ও দলীয় কোন্দলের কারণে একটি পক্ষ এসব তথ্য দুদকে সরবরাহ করে তাঁকে হয়রানি করছে।
গত ১৫ এপ্রিল দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ওমর ফারুক ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে মূল রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি চেয়ে চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে আবদুর রশিদের লেজারকিপার পদে চাকরির মূল ব্যক্তিগত নথির নোটশিটসহ সত্যায়িত কপি সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে চাকরি নেওয়ার সময় কোনো অনিয়ম, অবৈধ সম্পদ অর্জন অথবা চাকরি সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে মন্ত্রণালয় কিংবা সিটি করপোরেশন থেকে কোনো তদন্ত হয়েছে কিনা এবং তদন্ত হয়ে থাকলে সেই তদন্ত প্রতিবেদনের সত্যায়িত ছায়ালিপি সরবরাহ করতে বলা হয়।
জানা গেছে, ওই সব তথ্য ও কাগজপত্র অনুসন্ধান কর্মকর্তার হাতে পৌঁছেছে। তবে একটি সূত্র জানায়, বেশ কিছু নথিতে ঘষামাজা ও কাটাকাটি করার চিহ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধানকালে পর্যালোচনা করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অবৈধ সম্পদের অভিযোগ:
আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে দুদকে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে প্রধান অভিযোগ হলো অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ডিএনসিসির তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী, যার মাসিক মূল বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলে ৫ কাঠা জমিতে তাঁর একটি অত্যাধুনিক পাঁচ তলা বাড়ি আছে। রাজধানীর খিলক্ষেতে আছে দোতলা বাড়ি। এ ছাড়া নামে-বেনামে তার আরও কয়েক কোটি টাকার সম্পদ আছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। সিটি করপোরেশনে চাকরি নেওয়ার পর বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নাম ভাঙিয়ে লেজারকিপার থেকে রাজস্ব বিভাগে লাইসেন্স সুপারভাইজার পদে বদলি হন। কারওয়ান বাজারে অবস্থিত ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে দায়িত্ব নিয়ে একাই নিয়ন্ত্রণ করছেন চার-পাঁচটি ওয়ার্ড।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবৈধভাবে ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় টাঙ্গাইলের দিঘলিয়া এলাকার থানাপাড়া রোডের পানির ট্যাংকের সঙ্গে ৫ কাঠা জমিতে ‘মণ্ডলবাড়ি’ নামে অত্যাধুনিক পাঁচ তলা একটি বাড়ি তৈরি করেছেন রশিদ। এমন আধুনিক নকশা আর নান্দনিক বাড়ি ওই এলাকায় আর একটিও নেই। রাজধানীর খিলক্ষেতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন আরও একটি দোতলা বাড়ি (ক/এ-৩ /ডি খিলক্ষেত মধ্যপাড়া, পোস্ট অফিস রোড, ঢাকা)। এ ছাড়া রশিদের নামে-বেনামে আরও কয়েক কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে দুদক।
এ বিষয়ে রশিদ বলেন, তাঁরা পারিবারিকভাবে প্রচুর সম্পদের মালিক। সেখানে অবৈধ কোনো সম্পদ তাঁর নেই।
মোটরসাইকেল জালিয়াতি:
অভিযোগ রয়েছে, আবদুর রশিদ নিজে মোটরসাইকেল চালালেও ২০১৩ সালে ডিএনসিসি থেকে একটি নতুন মোটরসাইকেল (ঢাকা মেট্রো-ল-২৩-৭৭৮৩) বরাদ্দ নেন। পরে নগদ ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় ওই মোটরসাইকেলটি ডিএনসিসির এক কর্মচারীর কাছে বিক্রি করে দেন। মোটরসাইকেল বিক্রির পরও তিনি প্রতি মাসে ৩০ লিটার জ্বালানি তেলের টাকা তুলে নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনীতি ও বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কার:
আবদুর রশিদ ডিএনসিসি কর্মচারী লীগের সভাপতি। গত বছরের ১৮ অক্টোবর মিরপুরে সংগঠনের এক সভায় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে দেখা যায়, কর্মচারীরা রশিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, রশিদ বিভিন্ন পদে লোকজনকে চাকরি দেওয়া এবং পদোন্নতির কথা বলে ২০ জন কর্মচারীর কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন রশিদ। নেতাদের চাপের মুখে রশিদ পদত্যাগে বাধ্য হন।
আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে কমিটির নেতাদের সন্তানদের চাকরি দেওয়ার নামে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েও চাকরি না দেওয়ার ঘটনায় তারা লিফলেটও বিতরণ করেন। ডিএনসিসির শ্রমিক-কর্মচারী লীগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ওই লিফলেটে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে সংগঠন বিরোধী নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড, ঘুষ, দুর্নীতি প্রতারণা, জালিয়াতি এবং অঢেল সম্পদের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
তবে রশিদের দাবি, তাঁকে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়, যেটা শ্রমিক লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত জানেন।
বয়স লুকিয়ে চাকরি:
২০০৫ সালের ২৬ অক্টোবর শিক্ষানবিশ হিসেবে রাজস্ব বিভাগের লেজার কিপার পদে আবদুর রশিদ নিয়োগ পান। চাকরির আবেদনপত্রে তাঁর ক্রমিক নম্বর ছিল ১২৪৫। তখন ওই পদের বিপরীতে ১ হাজার ২৫১টি আবেদন জমা পড়েছিল।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমান ডিএনসিসিতে আবদুর রশিদের ব্যক্তিগত তথ্যাদিসহ সংরক্ষিত ফাইলে আবেদনপত্রের পে-অর্ডারের তারিখ ও পে-অর্ডার নম্বর কালো কালিতে এমনভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, যাতে তা পড়া না যায়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, লেজার কিপার পদে ২০০৪ সালে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় করপোরেশন। আবদুর রশিদ তাতে আবেদন করেন এবং তাঁর চাকরিও হয়। কিন্তু হাতে লেখা আবেদনপত্রে তাঁর জন্মতারিখ লেখা আছে ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি। সে অনুযায়ী ২০০৪ সালে তাঁর বয়স দাঁড়ায় ৩২ বছরের বেশি। সরকারি বিধি অনুযায়ী চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর।
নথিপত্রে দেখা যায়, আবদুর রশিদ চাকরির আবেদনপত্রে তাঁর বয়স লিখেছেন ২৬ বছর ১০ মাস ১৫ দিন। তিনি বয়সের হিসাব দেখিয়েছেন ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বয়স হিসাব করতে বলা হয় ২৫ জানুয়ারি ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এই সময় ধরলে তাঁর বয়স দাঁড়ায় ৩২ বছরের বেশি। অবশ্য আবেদনপত্রের সঙ্গে দেওয়া আবদুর রশিদের ব্যাংক পে-অর্ডারের তারিখ ২০০৪ সালের ২০ জানুয়ারি।
তাহলে ১৯৯৮ সালে বয়স হিসাব করার কারণ কী? অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই বছরও একই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ধূর্ততার সঙ্গে একই পদের জন্য আগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সময় ব্যবহার করে বয়স কমিয়ে দেখিয়েছেন আবদুর রশিদ। কিন্তু আবেদন করেছেন ২০০৪ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুসারেই। ব্যাংক পে-অর্ডারের তারিখও ২০০৪ সালের। তাঁর ধারণা, তৎকালীন কর্তৃপক্ষের কারও অনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া এই নিয়োগ সম্ভব হয়নি।
করপোরেশন সূত্র জানায়, তখনকার সরকারের উচ্চপর্যায়ের অন্তত দুজন ব্যক্তির সুপারিশ ছিল আবদুর রশিদের নিয়োগের জন্য। আর একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন, আবদুর রশিদ তখন বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে আবদুর রশিদ বলেন, ‘আমি শ্রমিক লীগের রাজনীতি করি। আমার প্রতিপক্ষের লোকজন আমাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে আমার বিরুদ্ধে এসব বলছে। আমার নথিতে এসব ভুল তথ্য সংযোজন তাদেরই কাজ।’
এদিকে ২০১৪ সালে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতির ২০টি লিখিত অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার বিভাগে আবেদন করেন এক ব্যক্তি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৮ মে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। সিনিয়র সহকারী সচিব সরোজ কুমার নাথের স্বাক্ষরে ডিএনসিসিকে একটি চিঠির মাধ্যমে আবদুর রশিদের লেজারকিপার পদে নিয়োগে অনিয়ম, নানা দুর্নীতি এবং কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের কথা বলা হয়। ওই চিঠিতে ডিএনসিসির প্রশাসক/মেয়র এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু গত ৪ বছরেও মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির আলোকে আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা ডিএনসিসির কেউই জানেন না।