‘দুই পক্ষের টানাটানিতে ৯ কোটি মানুষ ইন্টারনেটের বাইরে’

লেখক:
প্রকাশ: ২ ঘন্টা আগে

এনটিটিএন কোম্পানি আর মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেদের মধ্যে টানাটানি করে অবকাঠামো শেয়ার না করায় এখনো দেশের সব জায়গায় ইন্টারনেট পৌঁছানো যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিটিআরসির চেয়ারম্যান এমদাদ উল বারী।

ওই টানাপড়েনের কারণেই এখনো দেশের নয় কোটি মানুষ ইন্টারনেট সেবার বাইরে রয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেছেন, দুই পক্ষ যেন সহযোগিতার পথে আসে, সেজন্য তিনি ‘জোর খাটাতে চান’।

শনিবার (১২ জুলাই) ঢাকার একটি হোটেলে ‘টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং লাইসেন্সিং অবকাঠামো’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের টেলিকম খাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সামনে কথা বলছিলেন এই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান। টেলিকম ও প্রযুক্তি খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন টিআরএনবি এই বৈঠকের আয়োজন করে।

মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ব্যান্ডউইথ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ফাইবার অপটিক কেবল। ২০০৯ সালের আগে মোবাইল অপারেটরগুলো নিজেরাই এই কেবল স্থাপন করেছে, কেউ রেলের ফাইবার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছে।

এরপরে সরকারের সিদ্ধান্তে ফাইবার অপটিক কেবল স্থাপনের জন্য এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন থেকেই কেবলগুলোর নিয়ন্ত্রণ পায় এনটিটিএন কোম্পানিগুলো।

এখন দেশে সরকারি তিনটি এবং বেসরকারি তিনটি এনটিটিএন কোম্পানি রয়েছে। তবে বাজারে ‘ফাইবার অ্যাট হোম’ এবং ‘সামিট কমিউনিকেশন্সে’র আধিপত্য রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার এসব কোম্পানিকে ’অনৈতিকভাবে’ বাড়তি সুযোগ দিয়েছে কি না, সে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। তবে এনটিটিএন কোম্পানিগুলো সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

মোবাইল অপারেটরগুলো সেবার ক্ষেত্রে ত্রুটি ও উচ্চ মূল্যের জন্য এনটিটিএনগুলোকে দায়ী করে আসছে। এর বিপরীতে এনটিটিএন অপারেটরদের যুক্তি, ‘কমন নেটওয়ার্ক’ স্থাপনের ফলে ডেটার দাম কমানো সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি মোবাইল অপারেটর পৃথকভাবে ফাইবার অপটিক কেবল বসালে তাতে খরচ আর জটিলতাও বাড়বে বলে তাদের ভাষ্য।

মোবাইল অপারেটরগুলো এনটিটিএন এর কাছে ফাইবার অপটিক কেবল নেটওয়ার্ক ভাড়া নিতে (ডার্ক ফাইবার) চায়। আর এনটিটিএনগুলো চায় পরিবহন করা ব্যান্ডউইথের পরিমাণ অনুযায়ী দাম নিতে। কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে বসে এর সুরাহা করতে পারছিল না।

এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গত এপ্রিলে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে ডিডব্লিউডিএম (ডেনস ওয়েভলেন্থ ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং) এবং ডার্ক ফাইবার সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। অর্থাৎ মোবাইল কোম্পানিগুলো এনটিটিএন কোম্পানিগুলোর বসানো ফাইবারে তরঙ্গকে শক্তিশালী করার যন্ত্র ডিডব্লিউডিএম বসাতে পারবেন এবং খালি ফাইবার ভাড়া নিতে পারবে। কিন্তু এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়নি এখনো।

সে প্রসঙ্গ ধরে বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, “দেশের ৯ কোটি লোক এখনো কানেক্টিভিটির বাইরে। এর মধ্যে চার থেকে সাড়ে ৪ কোটি অ্যাডাল্ট, ১৫ বছরের ওপরে। এদের কাছে কোনো কানেক্টিভিটি নাই। আমাদের ৫০ শতাংশের কম ইন্টারনেট কাভারেজ। যদিও আমরা বলি আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৩ থেকে সাড়ে ১৩ কোটি। সেটা হচ্ছে যারা মাসে একবার দুই এমবি বা পাঁচ এমবি ব্যবহার করেছেন তাদের ধরে।

“তাদেরকে বাদ দিয়ে ধরলে রেগুলার ইন্টারনেট ব্যবহার করেন সাড়ে ৭ থেকে আট কোটি। আমাদের সাড়ে চার কোটি বাসাবাড়ি এই দেশে। দুই থেকে সোয়া দুই কোটি বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট অ্যাকসেস আছে। বাকি দুই আড়াই কোটির কোনো ইন্টারনেট অ্যাকসেস নাই।”

তিনি বলেন, “এই কাভারেজ গ্যাপ নিয়ে আমরা কথা বলছি। এই কাভারেজ দেওয়ার পেছনে শুরুতে বড় কাজ করেছে মোবাইল অপারেটরগুলো। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাকিটা কাভার করা গেল না কেন? কারণ আপনারা আপনাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার (অবকাঠামো) শেয়ার করেননি।

“আইএলডিটিএস পলিসিটা শুরু হয়েছিল অবকাঠামো শেয়ারিং ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য। এরপর নিয়ে আসা হল এনটিটিএনদের। এরপরই আমরা আটকে গেলাম। দুইপক্ষই এমন আচরণ করলেন যে আমি বললে সেটা খুবই কর্কশ শোনাবে, একজন বলেছেন, ‘ল্যাক অব ফেয়ার ডিজায়ার’।”

মোবাইল অপারেটর ও এনটিটিএন কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আপনারা চাইলেন নিজের ব্যবসা কারো কাছে দেবেন না। এনটিটিএন যারা এলেন, তারা ডার্ক ফাইবার দিতে চাইলেন না। মোবাইল অপারেটররা তাদের ট্রাফিকগুলো তাদের দিলেন না। এবং আপনারা নিজেদের মাসল ফ্লেক্স (পেশী বিস্তৃত) করলেন।

“দুই পক্ষই যে যেখানে পেরেছেন নিজেদের পেশী শক্তি দেখিয়েছেন। এনটিটিএনরা বন্ধ করে দিয়েছেন ডিডব্লিউডিএম দেওয়া। এই যে একটা বটল নেক হয়েছিল এটা যদি থাকে তাহলে এই ৯ কোটি মানুষ কানেক্টেড হবে না। এখন আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়েছি।”

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারী বলেন, প্রথম দিকে টুজি বিস্তারের জন্য টাওয়ার করেছেন মোবাইল অপারেটররা। টুজি তরঙ্গের রেঞ্জ অনেক বেশি। সেই টাওয়ারে যখন ফোরজি বসানো হল তখন এর রেঞ্জ দুই-তৃতীয়াংশে নেমে এল।

“একটা বিরাট গ্যাপ পড়ল। এখন আমাদের অনেক টাওয়ার দরকার এবং শেয়ারিং দরকার। কিন্তু আপনারা শেয়ার করছেন না। এই যে শেয়ারিংয়ের গাইডলাইন তো শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু আপনারা সেটা করেননি।”

ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ভারতের ফাইভ জি লঞ্চ করার জন্য ৫০ লাখ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক লাগবে বলে তারা নির্ধারণ করে। আজ তারা ৪৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক করেছে। আমাদের মাত্র পাঁচ লাখ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক লাগবে।

“গত ১৫-১৬ বছরে আমরা খাতা-কলমে এসেছি এক লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। তারমধ্যে এক লাখ ১৫ হাজার কিলোমিটার ওভারহেড ফাইবার। আমাদের এখানে অবশ্যই বিনিয়োগ দরকার। অবকাঠামো খাতে আমরা দেখেছি গত ১৫-১৬ বছরে তেমন ইনভেস্টমেন্ট হয়নি।”

বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, “আবার আছে ইউসেজ গ্যাপ (ব্যাবহারের গ্যাপ)। এটা পূরণ করার জন্য স্মার্ট ফোন ডিভাইস পেনিট্রেশন দরকার ছিল। আমি বুঝি এটা শুধু টেলকোর ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু টেলকো কী করেছে? আপনারা এক ধোঁয়া তুলছেন যে সিম লক না করলে আপনারা মোবাইল সেট দিতে পারছেন না। আমরা এবার এসে ডিভাইস ম্যানুফাকচারারদের বলেছি ডিভাইস লকের সিস্টেম করতে।”

নতুন নীতিমালা নিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আমরা বিষয়গুলোকে সহজ করতে চাই। আর যতটা সম্ভব ডিরেগুলেট করতে চাই। আমরা ছেড়ে দিতে চাই মার্কেটের ওপরে, কম্পিটিশনের ওপর ভিত্তি করে। আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে শুধু কম্পিটিশনটাকে চালিয়ে নিতে চাই।

“আমরা ভেবেছিলাম সবাই খুশি হবে এতে। কিন্তু কেউই খুশি না। কারণ, আপনারা কম্ফোর্ট জোন থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। সবাই যার যার জায়গা একটা ধরে বসে আছেন।”

এমদাদ উল বারী বলেন, “বলা হচ্ছে, খুব নাকি কনফিউশন রয়ে গেছে এই মাইগ্রেশন বা যাদেরটা (লাইসেন্স) বাতিল হবে তাদের কী হবে। আমরা যে পলিসিটা সাজেস্ট করেছি, তার সাথে একটি মাইগ্রেশন প্ল্যানও দিয়েছি। আমরা বলেছি, যে লাইসেন্স অলরেডি দেওয়া হয়েছে সেটা লাইসেন্স গ্রহীতার প্রতি সরকারের কমিটমেন্ট। মাঝখানে কোনো পরিবর্তন আন ইথিকাল। আমরা বলেছি যার যেই সময় বাকি আছে আমরা তাদের কোনো প্রকার শক্তি প্রয়োগ করব না। লাইসেন্স যখন শেষ হবে তারা যখন রিনিউ করবেন তখন সেটা নতুন লাইসেন্সিং রেজিমে সেটা হবে।

“আবার একদল আছেন যাদের লাইসেন্স ডিসকন্টিনিউ হবে, যাদের বাদ হয়ে যাবে বলা হচ্ছে। তারাও বাদ হচ্ছে না। আইজিডব্লিউ একটা গেটওয়ে, এটা একটা লাইসেন্সও। লাইসেন্স থাকুক আর না থাকুক সার্ভিসটাতো থাকবে। এখন যাদের আইজিডব্লিউ লাইসেন্স আছে তারা তাদের বর্তমান লাইসেন্সের মেয়াদ শেষে আবেদন করতে পারেন। অথবা তারা এখনই আবেদন করতে পারেন। আগে কনভার্ট করার ক্ষেত্রে আমরা ভাবছি এটার কোন ইনসনটিভ দেওয়া যায় কী না।”

যুথবদ্ধতার ওপর জোর দিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা বোঝারই চেষ্টার করছি না দ্য স্ট্রেংথ অব কোলাবরেশন। আমরা যে জায়গায় জোর খাটাতে চাই সেটা হল আপনারা এই খাতের বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা নিজেরা বসুন। আপনারা একটা সমাধান বের করুন। আমরা এই কোলাবরেশনটার জন্য জোর করছি। এই কোলাবরেশন ছাড়া আমরা একটা ডিজিটাল সর্ভিস ডেভেলপ করতে পারব না।”

টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দের সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্যদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব জহিরুল ইসলাম, গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান, রবির ভারপ্রাপ্ত সিইও রিয়াজ রশীদ, বাংলালিংকের সিইও ইওহান বুসে, টেলিটকের এমডি নুরুল মাবুদ, আইএসপিএবির সভাপতি আমিনুল হাকিমসহ খাত সংশ্লিষ্ট মোট ১৬ জন বক্তব্য দেন।