ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করে চাকরি হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন কর্মীরা। বকেয়া পরিশোধ না করায় গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসানের বিরুদ্ধে গত বছর ৬৫টি মামলা করেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। মামলা করার পর থেকে তাদের চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চাকরিচ্যুতির হুমকিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন মামলা দায়ের করা কর্মীরা। তারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন চাকরিচ্যুত হলে আমরা কীভাবে চলব, পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাব? শেষমেষ না খেয়ে মরা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান মামলা দায়েরকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা ওয়ার্কার পার্টিসিপেটের টাকা চাও। এটা কোর্ট (আদালত) নির্ধারণ করবে; তোমরা পাবা কি পাবা না? এর পরের স্টেপটা কী? কোর্ট যদি বলে দিয়ে দিতে; আমরা দিয়ে দেব। আর যদি না বলে, আমরা দেব না। আমার ধারণা তোমরা এতে জিতে যাবা। কারণ কোর্ট সবসময় ওয়ার্কারদের পক্ষে থাকে। কেসের (মামলা) ভেতরে গেলে একটা রায় হবে। রায় হওয়ার পরের দিন কী হবে? যারা কেস করেছে তাদের আমরা আর রাখব না। এটা পরিষ্কার সিদ্ধান্ত।’
তিনি আরও বলেন, ‘লোয়ার কোর্টের (নিম্ন আদালত) এসব ছোটখাট আদেশ দিয়ে লাফালাফি করার কিছু নাই। এটা উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থগিত হয়ে যাবে। এই ঝামেলার মধ্যে না যাওয়ার জন্য তোমাদের আবারও অনুরোধ করছি। মামলার রায় পেলে তোমরা মনে করছ, এইটা সব চাইতে সিকিউরড (নিরাপদ)। কিন্তু এটা সব চাইতে আন-সিকিউরড (অনিরাপদ)। আমরা চাচ্ছি এটা দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। যারা কেস করবে তাদের নিশ্চিত বিদায় নিতে হবে। এটা ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত।’ জাগো নিউজের কাছে এমন একটি ভিডিও সংরক্ষিত আছে।
‘হুমকি’ দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘যারা মামলা করেছেন তাদের তো কোনো হুমকি দেয়া হয়নি। তারা পাওনা টাকার জন্য মামলা করেছেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন আদালত। আমরা তো আদালতের বাইরে নই। আদালত যে সিদ্ধান্ত দেবেন আমরা তা মাথা পেতে নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘চার মাসের বেতন দিয়ে যে কাউকেই চাকরিচ্যুত করা যায়, আইনে এমন বিধান রয়েছে। এতে হুমকি দেয়ার কী আছে?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মামলার এক বাদী জাগো নিউজকে বলেন, বকেয়া টাকা পাওয়ার জন্য আমরা আদালতে মামলা করেছি। এটা তো আমাদের প্রাপ্য অধিকার। মামলা করে যদি চাকরি হারাতে হয়, তা হলে আমরা কার কাছে যাব? আদালত তো মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।’
তিনি বলেন, জীবনের মাঝপথে এসে চাকরি হারালে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব, কীভাবে চালাব পরিবার? আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে!
গ্রামীণ টেলিকমে কর্মরত অপর এক কর্মী বলেন, ‘বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকমে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১২০। এছাড়া ট্যালেন্ট সেন্ট্রিক নামক একটি থার্ড পার্টির ২৫ কর্মী এখানে কার্মরত আছেন। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো স্থায়ী পদে থার্ড পার্টি বা চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ দেয়া যায় না। কিন্তু সেটি মানা হচ্ছে না। এ কারণে আমরা আরও বেশি আতঙ্কগ্রস্ত।’
‘যে কোনো সময় আমাদের সরিয়ে থার্ড পার্টি থেকে কর্মী এনে কার্যক্রম শুরু করবে গ্রামীণ টেলিকম’- শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বলেন, ‘যারা মামলা করেছেন তাদের চাকরিচ্যুত করা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, বকেয়া পরিশোধ না করায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ৬৫টি মামলা দায়ের করেন তার প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের বর্তমান কর্মীরা। গত বছরের মার্চে তারা ঢাকার শ্রম আদালতে মামলাগুলো করেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ১৪ কর্মী আরও ১৪টি মামলা করেন পাওনা টাকার জন্য।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ টেলিফোনে এক-তৃতীয়াংশ শেয়ার রয়েছে গ্রামীণ টেলিকমের। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব পল্লীফোন ছাড়াও নকিয়া ও হুয়াওয়ের সার্ভিস দিয়ে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা কর্মীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকমের মুনাফা হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এ মুনাফা কর্মীদের পরিশোধ করা হয়নি। গত দশকে প্রতিষ্ঠানটির নিট মুনাফা ২১ হাজার কোটি টাকার পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ ১০৮ কোটি টাকা কর্মী ও সরকারকে দেয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওই অর্থের ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান কর্মীদের পরিশোধ, ১০ শতাংশ সরকার এবং ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ ফান্ডে জমা দেয়ার কথা।
মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান এবং এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিবাদী করা হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।