জেলেনস্কি: কমেডিয়ান থেকে সিরিয়াস নেতা

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

দুই প্রেসিডেন্টের ভেতর কতটা সাযুজ্য! একজনের নামের আগে ভ্লাদিমির, তো আরেকজনের নামের আগে ভলোদিমির। দুজনেই আইনের ছাত্র। দুজনের কেউই তাদের পেশাগত জীবনে আইন পেশাকে বেছে নেননি। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথা।

জেলেনস্কিকে অবশ্য জন্মের পরপরই চলে যেতে হয় মঙ্গোলিয়া শহর আরডেনেটে। যেখানে সবাই রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ফলে জেলেনস্কি ছোটবেলায় বেড়ে ওঠেন রুশ ভাষাতেই। তবে তিনি ইউক্রেনীয় এবং ইংরেজীতেও সমান পটু। মঙ্গোলিয়া যাওয়ার চার বছর পরেই আবার নিজের শহর ক্রিভয় রগে ফিরে আসেন। ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের শহর ক্রিভয় রগ।

ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের নেশা ছিল জেলেনস্কির। তাই ১৭ বছরের জেলেনস্কি নাম লেখান স্থানীয় কমেডি প্রতিযোগিতায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই সাফল্য তাকে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ করে দেয়। ২০১৯ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত সিনেমায় অভিনয় করে গেছেন সমান তালে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো তার বেশিরভাগ সিনেমা রুশ ভাষার। তবে ইউক্রেনীয় ভাষায়ও সিনেমা করেছেন জেলেনস্কি।

‘কোয়ার্টার ৯৫’ নামে একটি কমেডি টিম গঠন করেন তিনি যা ‘কেভিএন’ নামে একটি কমেডি প্রতিযোগিতায় ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চবার জয়ী হয়। কোয়ার্টার ৯৫ এর জন্য চিত্রনাট্য লিখতে গিয়ে জেলেনস্কির স্ত্রীর আর ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করা হয়নি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ না হলেও ওলেনা জেলেনস্কি কোয়ার্টার ৯৫ এর বসের সঙ্গে প্রেমের ইতি টানতে পেরেছেন জেলেনস্কিকে বিয়ের মাধ্যমে। জেলেনস্কি পরবর্তীতে কোয়ার্টার ৯৫ নামে একটি স্টুডিও গঠন করেন।

রাজনীতিতে জেলেনস্কি একেবারেই শিক্ষানবিশ ছিলেন কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থান তার রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্ত ভীত এনে দেয়। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় তার যথেষ্ট অনুসারী ছিল, যা পরবর্তীতে ভোটারে পরিণত হয় এবং একজন শিক্ষানবিশ রাজনৈতিক নেতাকে ভূমিধ্বস বিজয় এনে দেয়। ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন জেলেনস্কি। বিজয়ের পরপর অনেক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় জেলেনস্কিকে। যার প্রথমটাই ছিল রাশিয়ার কাছ থেকে। ক্ষমতা গঠনের পরপরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের কিছু অংশের মুক্তিকামীদের রাশিয়ার পাসপোর্ট দেয়ার ঘোষণা দেয়। এটা জেলেনস্কির জন্য ছিল বিশাল এক চাপ।

ডোনাল্ড ট্রাম্পও জেলেনস্কিকে ভীষণ চাপের মধ্যে রাখেন। তিনি সে সময়কার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া অভিযোগের তদন্তের জন্য জেলেনস্কির ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। যার জের ধরে ট্রাম্প ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য দেয়া সহায়তা আটকে দেন। ইউক্রেনের এনার্জি সংস্থার বোর্ডে জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন কাজ করতেন। ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, জো বাইডেন তার ছেলেকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার জন্য তার অফিসকে ব্যবহার করেছে, আদতে যার কোনো ভিত্তি ছিল না।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই জো বাইডেন ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দেন। আর বর্তমানে আমেরিকার মসনদে আছেন জো বাইডেন। আর ঠিক এই সময়েই আক্রান্ত হলো ইউক্রেন। জো বাইডেনের সঙ্গে পুরনো হিসাব-কিতাবের জেরেই কিনা কে জানে, ইউক্রেন হামলার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘জিনিয়াস’ আখ্যা দেন!

একজন কমেডিয়ান থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু জেলেনস্কি তার মেধা এবং জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ঠিকই বাজিমাত করেছেন ভোটযুদ্ধে জিতে। তাছাড়া আইনের ছাত্র হওয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অবস্থানকে আরও গতিশীল ভেবেছিল ইউক্রেনের জনগণ। কেননা জেলেনস্কি যাকে হারিয়েছিলেন সেই পেট্রো পোরোশেংকো ছিলেন বিলিয়নিয়ার। সেই তুলনায় একজন কৌতুক অভিনেতাকে ইউক্রেনের জনগণ বেশি কাছের মানুষ ভেবেছে, যার ফলশ্রুতিতে ৭৩ শতাংশ ভোটের মাধ্যমে পেয়েছিলেন বিজয়।

জেলেনস্কি অবশ্য তার এই গণরায়ের মান রেখেছেন। রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র জেলেনস্কিকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু জেলেনস্কি সেটা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘আমাকে নিরাপদে সরানোর দরকার নেই, আমার দরকার গোলা!’ জেলেনস্কির এই মন্তব্য সাধারণ মানুষ দারুণভাবে গ্রহণ করেছে। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে যেভাবে মানুষের মন জয় করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তার ভূমিকা সেদেশের মানুষের মন জয় করে চলেছে।