ভারত মহাসাগরের দেশ মালদ্বীপ। ১২০০ ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির স্থলভাগের মোট আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গ কিলোমিটার। এই দেশটি নিয়েই কূটনৈতিক মহারণে দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন। সম্প্রতি দেশটিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হেরে গেছেন চীনের পছন্দের আবদুল্লাহ ইয়ামিন। আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভারতপন্থী রাজনৈতিক দল। তবে কি মালদ্বীপে জিতেই গেল ভারত?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর এত সহজে মিলবে না। কারণ, চীনের ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে মালদ্বীপ। সেই বৃত্ত থেকে মালদ্বীপকে পুরোপুরি বের করতে হলে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বস্তা নিয়ে হাজির হতে হবে ভারতকে। তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ জিতে যাওয়ায় ভারত যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে বিজয়ী হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
গত রোববার মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছেন ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে প্রথম অভিনন্দন জানায় ভারত। কিন্তু মঙ্গলবার পর্যন্ত নীরব ছিল চীন। পরে অবশ্য চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা মালদ্বীপের জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দ্বীপ দেশটিতে ‘ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা’ চায়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, মালদ্বীপে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য চীনা উদ্যোক্তাদের আহ্বানও জানিয়েছে দেশটি।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে মালদ্বীপে সংকটের শুরু হয়েছিল। মুখোমুখি অবস্থান নেয় দেশটির আদালত ও সরকার। দেশটির সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ বিরোধীদলীয় নয়জন রাজনৈতিক বন্দীকে অবিলম্বে মুক্তির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বহিষ্কৃত ১২ জন আইনপ্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার আদেশও দেওয়া হয়। এটি হলে দেশটির ৮৫ সদস্যের আইনসভায় ওই সময়ই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যেত মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো।
স্বাভাবিকভাবেই প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন সরকার এটি মানতে রাজি হয়নি। কারণ, এতে যে গদিই যায় যায়! তাই সরকার জানাল, আদালতের আদেশ না মানার সিদ্ধান্ত, উঠল প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের অভিযোগ। জারি হয় জরুরি অবস্থা। রাতারাতি ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে আটক হয়ে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবদুল্লাহ সাঈদসহ দুই বিচারপতি। কারাগারে যেতে হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকেও। এরপরই উল্টে যায় পাশার দান। রায় বদলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির আদেশ প্রত্যাহার করেন।
ওই টানাপোড়েনের সময় আশঙ্কা করা হয়েছিল, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মালদ্বীপে সেনা পাঠাতে পারে ভারত। এমনকি সেনা নাকি প্রস্তুতও রাখা হয়েছিল। ওদিকে স্বেচ্ছা নির্বাচনে থাকা সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদও ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তখন আবদুল্লাহ ইয়ামিনের পাশে দাঁড়িয়ে যায় চীন। দেশটি তখন বলেছিল, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।
এত ঘটনার ঘনঘটার পর এ সপ্তাহের নির্বাচন ও তার ফলাফল কিছুটা চমক জাগানিয়া তো বটেই। মোহাম্মদ নাশিদের আত্মীয় ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। চলতি বছরের নভেম্বরে ক্ষমতা গ্রহণের কথা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের।
কে এই নতুন প্রেসিডেন্ট?
মালদ্বীপে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। ৫৬ বছর বয়সী এই রাজনীতিক একসময় সাংবাদিক ছিলেন, কাজ করেছেন রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমেও। মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। দেশটিতে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক সংস্কার চালানো হয়েছিল, ইব্রাহিম ছিলেন তার অন্যতম পুরোধা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, মালদ্বীপের আধুনিক সংবিধানের খসড়া তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিনি দেশটিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও মৌলিক মানবাধিকারের ধারণার প্রবক্তা। দ্বীপ দেশটির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, যেকোনো সংকটজনক পরিস্থিতিকে ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করার ক্ষমতা আছে ইব্রাহিমের।
ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাশিদের ভগ্নিপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। মালদ্বীপে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সামর্থ্য আছে তাঁর। তবে সে জন্য নিজের ঠান্ডা মাথার সর্বোচ্চ ব্যবহার তাঁকে করতে হতে পারে।
এবারের নির্বাচনে সব বিরোধী দলই ইব্রাহিমকে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে। এর অন্যতম কারণ হলো, নাশিদ ও মামুন আবদুল গাইয়ুমের অনুপস্থিতি। একই সঙ্গে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে ভোটবাক্সে লড়াই করার মতো ‘ক্লিন ইমেজের’ প্রার্থীর কোনো বিকল্প ছিল না। সেই অভাবটিই পূরণ করেছেন ইব্রাহিম।
মালদ্বীপে কেন আগ্রহী ভারত-চীন?
মোটে চার লাখ মানুষের দেশ হলো মালদ্বীপ। দেশটিতে এমন কোনো আহামরি সম্পদও নেই, যার জন্য হামলে পড়বে ভারত ও চীন। দেশটির মূল গুরুত্ব এর ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। বিশেষ করে ভারত মহাসাগরের শিপিং লেনগুলো (বাণিজ্যিক সমুদ্রপথ) গেছে দেশটির হাজারো দ্বীপের কোল ঘেঁষে। আর এর জন্যই দেশটিতে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায় নরেন্দ্র মোদি ও সি চিন পিংয়ের দেশ।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিং তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মালদ্বীপকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। ২০১৩ সালের পর থেকেই মালদ্বীপ ক্রমে চীনঘেঁষা হয়ে পড়ে। ওই সময় থেকে দেশটিকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প।
সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি বিমানবন্দর ও সেতু নির্মাণের জন্য প্রায় ৮৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। তৈরি হচ্ছে ২৫ তলা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ও হাসপাতাল। একই সময়ে মালদ্বীপের পর্যটনেও অনুরূপ ভূমিকা রেখেছেন চীনারা। গত বছর দ্বীপ দেশটিতে শুধু চীন থেকেই বেড়াতে গেছেন তিন লাখেরও বেশি পর্যটক।
ভারতের আশঙ্কা, মালদ্বীপকে এভাবে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইছে চীন। ভারতকে কোণঠাসা করতে পুরো অঞ্চলে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক নেটওয়ার্ক তৈরি করার চেষ্টা চলছে। আর তারই অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে মালদ্বীপকে।
এশিয়া টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছরের শুরুতে চীন ও মালদ্বীপ মিলে একটি যৌথ সমুদ্র পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আরও ক্ষুব্ধ হয় ভারত। কারণ মোদির দেশ মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের বাণিজ্যিক সমুদ্রপথে নজরদারি শুরু করতে চাইছে চীন।
তাই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক—এই তিন কৌশলগত কারণে মালদ্বীপ নিয়ে রেষারেষি শুরু হয়েছে ভারত ও চীনের মধ্যে।
ভবিষ্যৎ কী?
মালদ্বীপ পুরোপুরি পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় এর পর্যটন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটির মানুষের মাথায় পড়েছে বিপুল ঋণের বোঝা।
রয়টার্স বলছে, মালদ্বীপের কাছে শুধু চীনই পাবে প্রায় ১৩০ কোটি ডলার। এই অর্থের পরিমাণ দেশটির মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বিপুল ঋণ থেকে সহজে মুক্তি পাবে না মালদ্বীপ।
১৯৭৮ থেকে ২০০৮—এই সময়টা ভারতের ‘পুরো নিয়ন্ত্রণে ছিল’ মালদ্বীপ। ওই সময় দেশটির শাসক ছিলেন মামুন আবদুল গাইয়ুম। তখন দেশটিতে পর্যটন খাত বেশ সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল। তবে নিন্দুকেরা বলেন, গাইয়ুমের স্বেচ্ছাচারিতার শাসনে দেশটিতে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর থেকেই দেশটির রাজনীতি আছে টালমাটাল অবস্থায়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ নির্বাচিত হওয়ায় রাজনৈতিক সুবিধা পাবে ভারত। বিরোধীরা আগেও বলেছেন, ইয়ামিনের আমলে হওয়া দুর্নীতি এবং চীনা তহবিলে নেওয়া প্রকল্পের পর্যালোচনা করা হবে। সুতরাং চীন এখন কিছুটা ব্যাকফুটে। এই সুযোগ ভারত ছাড়বে বলেও মনে হয় না।
হয়তো মালদ্বীপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো সময় পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু চীন-ভারত রেষারেষি সহজে শেষ হওয়ার নয়। সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেভিড ব্রুস্টারের জবানিতে বলা হয়েছে, ‘মালদ্বীপের নতুন সরকার হয়তো চীনঘেঁষা কৌশলে পরিবর্তন আনবে। তবে এই পদক্ষেপ চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতার আরেকটি অধ্যায় ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়।’