উত্তর আফ্রিকার এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক লিবিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে নির্মমভাবে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। আর তার মৃত্যুর ৭ বছর পরও তার পরিবারের ভাগ্য আজও রহস্যাবৃত।
সম্প্রতি তার ছেলে হ্যানিবলের ওপর লেবানন ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর ফলে তিনি আগামী এক বছর লেবানন ছেড়ে যেতে পারবেন না। এই আদেশের ফলে গাদ্দাফির পরিবারের সদস্যদের ‘রহস্যাবৃত ভাগ্য’ নিয়ে ফের জল্পনা শুরু হয়েছে।
অনেকে বলছেন, হ্যানিবলকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। আবার অনেকে বলছেন, তার বাবার অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া ঠিক হবে না। অনেকে আবার এই বিষয়ে লিবিয়ার কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চাইছেন এবং লোকের সামনে সত্য তুলে ধরতে বলছেন।
‘বিদ্রোহী’দের ‘বিপ্লবে’র সময়ই গাদ্দাফির ৯ সন্তানের তিনজনকে হত্যা করা হয়। সেসময় তার ছেলে মুতাসিম বিল্লাহকেও হত্যা করা হয় যিনি দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। বাকী ৬ জনকে বেঁচে আছেন। তবে তারা ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন।
আল সাদি ত্রিপলির কারাগারে বন্দী আছেন। হ্যানিবল আছেন লেবাননে। আর সাইফ আল ইসলাম আছেন অজ্ঞাত স্থানে। গাদ্দফির স্ত্রী সাফিয়া ফারকাশ তার মেয়ে আয়েশাকে নিয়ে আলজেরিয়ায় আছেন। অন্যদিকে গাদ্দাফির প্রথম স্ত্রী ফাতিহার ছেলে চলে গেছেন ওমানে। গাদ্দাফির পালিতা মেয়ে হানা ১৯৮৬ সালে ত্রিপলিতে যুক্তরাষ্ট্রের এক বোমা হামলায় মাত্র ৪ বছর বয়সে নিহত হয়।
লেবাননের এক বিচারক গাদ্দাফির পঞ্চম ছেলে হ্যানিবলের ওপর লেবানন ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এক বছরের জন্য। হুসেইন হেবেইশ নামের এক লেবাননি নাগরিক তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি, অপহরণ এবং হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছেন। সোমবার লেবাননের পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার এই খবর দিয়েছে।
গত ১২ জুলাই বিচারক রিতা ঘান্টৌস রায় দেন হ্যানিবল আগামী এক বছর দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না।
মামলার অভিযোগে হুসেইন হেবাইশ বলেন, ২০১৬ সালে লিবিয়া সফরে যান তিনি। আর সেই সময়েই তাকে অপহরণ করে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। যারা হ্যানিবলের প্রতি অনুগত। অপহরণের পর তারা হুসেইনের মুক্তির বিনিময়ে হ্যানিবলের মুক্তি দাবি করেন লেবানন সরকারের কাছে।
হ্যানিবল এখন লেবাননের বিচার বিভাগকে অপমানের দায়েও দেড় বছরের জেল খাটছেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে লেবানন কর্তৃপক্ষ তাকে শিয়া ইমাম মুসা আল সদরের গুম হওয়ার মামলায় আটকে রেখেছেন। ইমাম মুসা আল সদর ১৯৭৮ সালে দুই সঙ্গী সহ লিবিয়া সফরে গিয়েছিলেন গাদ্দাফির আমন্ত্রণে।
লিবিয়ার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আল-আবানি বলেন, বাবার অপরাধের জন্য হ্যানিবলকে দোষারোপ করাটা ‘অন্যায় এবং বিতর্কমূলক হবে’। তিনি বলেন, কী করে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপরাধের জন্য একজন ব্যক্তিতে শাস্তি দেওয়া যায়? আর তাছাড়া হ্যানিবল তখন বয়সে একজন শিশু ছিল।
আল সাদি আছেন লিবিয়ার কারাগারে।
লিবিয়ার জনগনও গাদ্দাফির পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যত নিয়ে এবং দেশে অবস্থান করা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। অনেক গোত্র এবং রাজনৈতিক দল আছে যারা চায় গাদ্দাফির সন্তানরা লিবিয়ায় ফিরে আসুক এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে অন্তুর্ভুক্ত হউক।
তবে লিবিয়ার একটি সূত্র জানায়, দেশটির অনেক রাজনীতিবিদ আছেন যারা চায় না গাদ্দাফির পারিবার লিবিয়ায় ফিরুক।
ওই সূত্র গাদ্দাফির পরিবারের ভবিষ্যত নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানান। কেননা সাইফ আল ইসলাম নিখোঁজ আছেন। আর তার বোন আয়েশা লিবিয়ার বাইরে চলে গেছেন। আর অপর ভাই আল সাদি আছেন কারাগারে।
গাদ্দাফির ৭ম ছেলে খামিস যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। কিন্তু লিবিয়ায় বিপ্লব শুরু হওয়ার পর ফিরে এসেছিলেন। এবং ২০১১ সালের আগস্টে নিহত হন। গাদ্দাফির ৬ষ্ঠ ছেলে সাইফ আল-আরবও ২০১১ সালের ৩০ এপ্রিল মিউনিখ থেকে ফিরে আসার পর নিহত হন।
২০১৭ সালের ১১ জুন লিবিয়ার জিনতান শহরের নিয়ন্ত্রণকারী গেষ্ঠী আবু বকর আল-সিদ্দিক ব্রিগেডের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে সাইফ আল ইসলামকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তাকে লিবিয়ার অন্তবর্তীকালীন সরকারের অনুরোধে মুক্তি দেওয়া হয় বলে জানায় ওই ব্রিগেড।
তবে নিজেদেরকে সাইফ আল ইসলামের ঘনিষ্ঠ দাবিকারী এমন অনেকে আছেন যারা তার পক্ষ থেকে লিবিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করছেন। এবং নানা সময়ে তার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতি প্রচার করেন। তারা বলছেন, সাইফ আল ইসলাম আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী।
২০১৫ সালে লিবিয়ার বিচার বিভাগ সাইফ আল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের বিপ্লব সহিংস কায়দায় দমনের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও সাইফ আল ইসলামের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। তার বাবা গাদ্দাফির শাসনকালে সে ওইসব অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ।
লিবিয়ার রাজনীতিবিদ সুলেমান আল-বায়ুদি লেবাননে হ্যানিবলের গ্রেপ্তার ও তার অবস্থার ব্যাপারে লিবিয়ার সরকারের কোনো ভুমিকা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি লিবিয়ান কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানতে চেয়েছেন। এবং একজন লিবিয়ান নাগরিক হিসেবে তার পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আয়েশার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তার ওপর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছিল। গত বছরের মার্চে আয়েশার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারন আদালত। আর তার মা সাফিয়ার ওপর জারি করা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।