ছিলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে পাকিস্তান করেছিল বিশ্বজয়। শুধুই একজন ক্রিকেটার হলে কথা ছিল, ইমরান খান ছিলেন সত্যিকারের একজন অধিনায়ক। যার ছায়াতলে পুরো একটি দেশ, একটি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা ক্রিকেটে হোক কিংবা রাজনীতিতে। ১৯৯২ সালে ক্রিকেট দিয়ে একসুতোয় পুরো দেশকে বেধে ফেলেছিলেন ইমরান খান। ২৬ বছর পর আবারও একসুতোয় বাধলেন, তবে সেটা রাজনীতি দিয়ে।
বিশ্বকাপ জয়ের ২৬ বছর পর এসে পরমাণু শক্তিধর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আরোহন করলেন ইমরান খান। পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ দিয়ে সংসদীয় আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন। যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে তার ক্ষমতারোহনের ক্ষেত্রে কোনোটাই বাধা হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে বসে গেলেন ইসলামাবাদের মসনদে।
ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর আবারও আলোচনায় উঠে এলো, খেলার ময়দান থেকে আর কোন কোন ব্যক্তিত্ব উঠে এলেন রাজনীতির ময়দানে! যে আলোচনায় অবধারিতভাবেই সবার আগে উঠে আসবে এখন ইমরান খান। এরপর এই তালিকায় নাম উঠবে লাইবেরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জর্জ উইয়াহ’র নাম।
জর্জ উইয়াহ
খেলার ময়দান থেকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এতদিন ছিলেন কেবল একজন। তিনি জর্জ উইয়াহ। চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক এই তারকা ফুটবলার।
মনরোভিয়ার একটি বস্তি থেকে ফুটবল নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন জর্জ উইয়াহ। এরপর শুধু আফ্রিকা নয়, হয়েছিলেন বিশ্বসেরা ফুটবলার। খেলেছেন ইউরোপ সেরা নামি-দামি ক্লাবগুলোতে। ১৯৯৫ সালে জিতেছেন ফিফা বর্ষসেরা এবং ব্যালন ডি’অরের পুরস্কার। জর্জ উইয়াহ’ই ছিলেন প্রথম নন-ইউরোপিয়ান ফুটবলার, যার হাতে শোভা পেয়েছিল ব্যালন ডি’অর। এরপর রোনালদো, রিভালদো, কাকা, মেসিদের হাতে উঠেছে ফুটবলে সেরার এই স্বীকৃতি।
লাইবেরিয়ায় চলা নৃশংস গৃহযুদ্ধকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন উইয়াহ। তবে গৃহযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর নিজের অর্জিত সম্পদ এবং খ্যাতি কাজে লাগিয়ে দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার শপথ করেন। সে লক্ষ্যে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে হেরে যান। ১২ বছর পর এসে সফলতার মুখ দেখেন উইয়াহ। ইলেন জনসন শারলিফের উত্তরসূরী হিসেবে প্রেসিডেন্ট শপথ নেন। ১৯৪৪ সালের পর ২০১৭ সালের শেষ ভাগে এসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনই ছিল লাইবেরিয়ার পূর্ণ গণতন্ত্রের পথে যাত্রার প্রথম নির্বাচন।
আরনল্ড শোয়ের্জনেগার
একাধারে খেলোয়াড়, অভিনেতা এবং রাজনীতিবীদ। মার্কিন এই ব্যক্তিত্বকে নির্দিষ্ট কোনো একটি বিষয় দিয়ে মাপা যাবে না। রূপালি পর্দা এবং রাজনীতিতে আসার আগে অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত এই আমেরিকান ছিলেন একজন বিশ্বখ্যাত বডিবিল্ডার। তারও আগে ছিলেন ভারোত্তোলক।
বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় আরনল্ড শোয়ের্জনেগার ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সারা বিশ্বে অপ্রতিরোধ্য বডিবিল্ডার হিসেবেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনও তার স্টাইলকে আরনল্ড ক্ল্যাসিক হিসেবে অভিহিত করা হয়। অবসর নেয়ার পরও এখনও পর্যন্ত বডি বিল্ডিং জগতে তার নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করা হয়। মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার সর্ব কনিষ্ট শিরোপাধারীর রেকর্ড এখনও অক্ষুণ্ন রেখেছেন শোয়ের্জনেগার।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন মাশল অ্যান্ড ফিটনেস ও ফ্লেক্স ম্যাগাজিনে নিয়মিত বডি বিল্ডিংয়ের ওপর কলাম লিখতেন শোয়ের্জনেগার। রাজনীতিতে আসার পর যখন গভর্নর নির্বাচিত হলেন, এরপর দুটি ম্যাগাজিনেরই ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে এবং তারা বছরে আড়াই লাখ ডলার করে শোয়ের্জনেগারের ফিনটেস সম্পর্কিত বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে দান করবে।
বডিবিল্ডিং এবং ভারোত্তোলণ ছেড়ে দেয়ার পর হলিউডে নাম লেখান শোয়ের্জনেগার। এখানেও রাজত্ব চলে তার। তবে সর্বশেষ টার্মিনেটর সিনেমায় অভিনয় করে নিজের নামের পাশে টার্মিনেটর হিরো হিসেবে খ্যাতি জুড়ে দেন। অভিনয়ের পাশাপাশি রাজনীতিতেও নাম লেখান শোয়ের্জনেগার। মডারেট রিপাবলিকান হিসেবে খ্যাত অর্জন করেন এবং ২০০৩ সালে প্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন শোয়ের্জনেগার।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা
আরেকজন বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার। ইমরান খানের (১৯৯২) পরের আসরেই, ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা যে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছে, তা কেবল রানাতুঙ্গার দৃঢ় এবং তুখোড় নেতৃত্বের কারণেই। জাতিগত দাঙ্গা (তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে) থামিয়ে দিতে পেরেছিল রানাতুঙ্গার বিশ্বজয়। যা শেষ পর্যন্ত এগিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগিয়েছে।
বিশ্বকাপ জয়ের পরও বেশ কিছুদিন ক্রিকেট খেলে গেছেন। ১৯৯৯ সালে ওয়ানডে এবং ২০০০ সালে অবসর নেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে। অবসরের পরপরই নাম লেখান রাজনীতিতে। যোগ দেন শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টিতে। কলম্বো জেলা থেকে নির্বাচিত হন পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে। ২০০৫ সালেই প্রেসিডেন্ট মহিন্দ রাজাপক্ষের অধীনে নিয়োগ পান জুনিয়র ট্যুরিজম মিনিস্টার হিসেবে।
যদিও ২০০৮ সালে এসে বিরোধী দলে চলে যেতে হয় দীর্ঘদিনের জন্য। ২০১৫ সালে এসে আবারও ক্ষমতায় ফেরে রানাতুঙ্গার দল। এই সময় এসে প্রথমবারেরমতো ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন রানাতুঙ্গা। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন পোর্ট অ্যান্ড শিপিং মিনিস্টার। এরপর দায়িত্ব নেন মিনিস্ট্রি অব পেট্রোলিয়াম রিসোর্চ ডেভেলপমেন্টের।
সম্প্রতি রানাতুঙ্গার সঙ্গে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের জোর বাগ-বিতণ্ডা চলছে দেশটির ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট নিয়ে। তবে, ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কায়ও রানাতুঙ্গাকে ঘিরে নতুন মেরুকরণের চিন্তা ভাবনা চলছে বলেও খবরে প্রকাশ।
ম্যানি প্যাকিয়াও
বক্সিং রিংয়ের বিখ্যাত এক যোদ্ধা। বিশ্বজোরা খ্যাতি। ফ্লোয়েড মেওয়েদারের সঙ্গে বিখ্যাত কয়েকটি মুষ্টিযুদ্ধের জন্মদাতা ম্যানি প্যাকিয়াও। ফিলিপাইনের রাস্তা থেকে উঠে এসে যিনি হয়েছেন বিশ্বসেরা মুষ্টিযোদ্ধা। দারিদ্র্যপীড়িত লক্ষ-কোটি ফিলিপাইনির অনুকরণীয় এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন প্যাকিয়াও।
৮ ভিন্ন ভিন্ন ওজন শ্রেণীতে ১২টি বিশ্বসেরার শিরোপা জিতেছেন ফিলিপাইনের এই মুষ্টিযোদ্ধা। বক্সিং রিংয়ে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন প্যাকিয়াও, ঠিক একইভাবে খ্যাতি এসেছে তার রাজনীতিতেও। ফিলিপাইনের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে প্রথম নির্বাচিত হন প্যাকিয়াও। এরপর ২০১৬ সালে নির্বাচিত হন সিনেটে। যেটা হচ্ছে আবার ফিলিপাইনে জাতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। যেখান থেকে কোনো একদিন প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন প্যাকিয়াও।
ভিতালি ক্লিশ্চকো
২ মিটার (৬ ফুট ৬ ইঞ্চি) উচ্চতার ভিতালি ক্লিশ্চকো ছিলেন হ্যাভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। কখনোই নকডাউনের মুখোমুখি হননি তিনি। ইউক্রেনের প্রতিবাদী নেতা এবং বর্তমানে কিয়েভের মেয়র।
বিশ্ব বক্সিংয়ে প্রায়ই তাকে মনে করা হতো অনেক বুদ্ধিমান একজন বক্সার। জানতেন অনেকগুলো ভাষা। একই সঙ্গে স্পোর্টস সায়েন্সে রয়েছে তার পিএইচডি। দস্তয়ভস্কিতেও অনেক বেশি ডুবে থাকতেন। যেটা তাকে অনেক রিল্যাক্স এনে দিতো।
ইউক্রেনে কমলা বিপ্লবের শুরুর দিকে এর কট্টর সমর্থক ছিলেন ক্লিশকো। তবে ইউক্রেনিয়ান রাজনীতিতে ওলট-পালট কারীদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে এক সময় খুব পরিচিতি পেয়ে যান তিনি। যার মাধ্যমে একসময় (২০১৪) তিনি নির্বাচিত হয়ে যান কিয়েভের মেয়র হিসেবে। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মেয়র হওয়ার চেয়ে একজন হ্যাভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়া অনেক সহজ।’
রোমারিও
ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার। ১৯৯৪ সালে তার অসাধারণ নৈপুণ্যের ওপর ভর করেই ২৪ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল লাতিন আমেরিকার পাওয়ার হাউস ব্রাজিল। ১৯৮৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খেলেন ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে। এরপর ক্লাব ফুটবল চালিয়ে যান আরও বেশ কয়েক বছর। ২০০৭ সাল পর্যন্ত খেলেছেন ক্লাব ফুটবলে। আবার কোচও ছিলেন তিনি। ২০০৭-০৮ সালে কোচের দায়িত্ব পালন করেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ভাস্কো দা গামায়।
হঠাৎ করেই কোচিং ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে নাম লেখান রোমারিও। ব্রাজিলিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি এবং ২০১০ সালে ব্রাজিলের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেম্বার অব ডেপুটি হিসেবে নির্বাচিত হন। রিও ডি জেনিরো থেকে ৬ষ্ঠ সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী ছিলেন তিনি।
তবে, রাজনীতিকে তিনি ব্যবহার করেছেন ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে আয়োজকদের বিপক্ষে। বিশেষ করে দুর্নীতি, মানি লন্ডারিংয়ের বিপক্ষে এবং ব্রাজিলজুড়ে চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে ছড়িযে-ছিটিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির উন্নয়নে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন।
২০১৪ সালেই ব্রাজিল সিনেটে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন রোমারিও এবং নির্বাচিত হন রিও ডি জেনিরো থেকে। ২০১৭ সালে এসে দল পরিবর্তন করেন তিনি। ব্রাজিল সোশ্যালিস্ট পার্টি ত্যাগ করে যোগ দেন পোডেমসে এবং রিও ডি জেনিরোতে নিজ দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন পোডেমস পার্টি থেকে রিও ডি জেনিরোর গভর্নর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।