রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ক্রপ সায়েন্স অ্যঅন্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে র্যাগিয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। বিভাগের সিনিয়রদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ক্যাম্পাস ছেড়ে শুক্রবার সকালে বাড়িতে চলে গেছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে র্যাগ দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ওই শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম ফাহাদ বিন ইসমাঈল। তিনি ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ¯স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ তার বন্ধুরা মিলে বিভাগের শিক্ষক ও কয়েকজন সিনিয়রদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মেসেঞ্জার গ্রুপে রসিকতামূলক মন্তব্য করে। আর এ মন্তব্যের জের ধরে বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে ওই শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। র্যাগিয়ের শিকার হয়ে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরে ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সকালে নারায়ণগঞ্জে তার বাড়িতে চলে যান।
র্যাগিংয়ে শিকার ফাহাদ তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, র্যাগের প্রভাব যেন আর কোনো মা-বাবার উপর না পড়ে। আমি নিজের মর্যাদাহানি করতে পারব, কিন্তু আমার মা-বাবাকে অপমাণিত হতে দিব না। তাই আমার স্বপ্নকে ছাড়তে সম্মত হলাম। বিদায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ফাহাদ বিন ইসমাঈল বলেন, প্রথম বর্ষের পরিচিতি ক্লাসের দিনে স্যুট পরে এসেছিলাম। যা বিভাগের সিনিয়রদের দৃষ্টিকটু মনে হয়। এদিন আমাকে হুমকি দেয়া হয় যে আমাকে র্যাগ দেয়া হবে। পরের দিন ক্লাসে আমাকে দাঁড় করিয়ে বলে যে আমি বেশি স্মার্ট হয়ে গেছি, আমার চুল বড়, আমাকে ন্যাড়া করতে হবে, এরকম নানা কথা বলেন তারা।
তিনি বলেন, সেকেন্ড ইয়ারের ভাইয়ারা আমাকে হুমকি দিয়েছিলেন বিভাগে না যেতে। গেলে আমার খুবই খারাপ হবে। তারপরও আমি বৃহস্পতিবার ক্লাসে যাই। সেখানে আল-আমীন ভাইয়া ও দ্বিতীয় বর্ষের কয়েকজন ভাইয়া-আপু আমাকে র্যাগিং করা শুরু করে। তারা আমাকে কৃষি অনুষদের ভবনের ভেতরে আটকে রেখে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করে। তারা আমার প্যান্ট, শার্ট খুলতেও বাধ্য করেছিল।
বিকেল ৪টার পর ওই ভাইয়া আর আপুরা আমাকে ভবনের বাইরে মাঠের মধ্যে নিয়ে আসে। সেখানেও তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ও নানা রকম মানসিক নির্যাতন করে বলে ইসমাঈল অভিযোগ করেন।
বিভাগের শিক্ষকদের এ বিষয়ে জানিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোনো শিক্ষককে অভিযোগ করিনি। আমি খুব ভয় পেয়েছি। মেসে এসে মাকে ফোন দিয়ে এ বিষয়ে বললে উনারা আমাকে বাড়িতে আসতে বলেন। আমি বাড়ি যাই।
তবে বিভাগের চেয়ারম্যান তাকে ফোন দিয়েছিল বলে জানান তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার করে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন দাবি করেন, তিনি র্যাগিংএ উপস্থিত ছিলেন না। তবে র্যাগ দেয়া হয়েছে এটা তিনি শুনেছেন। ঠিক কী কারণে র্যাগ দেয়া হয়েছে ওই শিক্ষার্থীকে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, শুনেছি বড় আপুদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে সে। এ কারণে তাকে শাসন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি বিষয়টি আসলে জানতাম না। সাংবাদিকের ফোন পেয়েই জেনেছি। গতকাল লাঞ্চ পর্যন্ত ক্লাস হয়েছে। তারপরে সবাই চলে গেছে। এরপর কী হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো শিক্ষার্থী আমাকে অভিযোগ দেয়নি। পরে আমি দু-এক জায়গায় ফোন দিয়ে জানতে পারলাম, আসলে এরকম কিছু ঘটেনি। সিনিয়র শিক্ষার্থীরা আগের দিন ওদের বরণ করে নেয়। সিনিয়রদের নিয়ে ওই শিক্ষার্থী নাকি ফেসবুকে ‘খারাপ’ কমেন্ট করেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো সিনিয়ররা তাদের কিছু শাসন করেছে।
ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তিনি বলেন, সেই ছেলেকে আমি ফোন দিয়েছিলাম। তো ও আসলে এখানে পড়বে না বলে মনে হল তার অ্যাটিটিউটে। আমি তার ডিপার্টমেন্টের একজন চেয়ারম্যান, অনুষদের একজন ডিন, আমি যেন ওর বড় ভাই এরকম একটা আচরণ ফোনে। এমন আচরণে পরে আমি ফোন কেটে দিয়েছি। তবে এসব বিষয়ে যদি কেউ দোষী হয়ে থাকে, তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তি দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, র্যাগের কারণে ওই শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে গেলে তাহলে এটি খুবই অশালীন বিষয়। এ বিষয়ে আমাকে কেউ অভিযোগ করেনি। যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো র্যাগের বিষয় দৃষ্টিগোচর হলে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, আমি বিষয়টি বিভাগের সভাপতিকে জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলব। যদি তারা যথাযথ পদক্ষেপ না নেয় তবে বিশ্ববিদ্যালয় যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে।