২০১৭ সালের বরিশালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার মধ্যে যারপরনাই বিতর্কিত এবং সমালোচিত ঘটনা আগৈলঝাড়ার ইউএনও তারিক সালমনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা এবং আদালতের জামিন বাতিল কান্ড। যে খবর গোটা দেশের প্রশাসনসহ সর্বত্র নাড়া দিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকেও উত্থাপিত হয়েছে। মহামারি মাত্রায় সমালোচিত ওই ঘটনার অন্যতম ঘটক মামলাটির বাদী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত নেতা অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। সে সময় এক জরুরি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দলীয় নেতাদের কাছে প্রশ্নও করেছিলেন, কে এই সাজু ?
ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় দেশের বাঘা বাঘা জাতীয় সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনামে ওই কান্ডের জন্য বরিশাল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতাকে দায়ী করে সংবাদ প্রকাশ হয়। সাজুর পাশাপাশি ওই নেতাও বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে। তবে পত্রিকার সেই পর্যবেক্ষণমূলক সংবাদ যে অসত্য নয়, তা প্রমাণ হয়েছে বিতর্কিত সেই কর্মকান্ডের জন্মদাতা অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু এ বছরের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পুনরায় আ’লীগের সমর্থন প্রাপ্তির পর।
দলীয় নেতারা এবং নির্দলীয় সকলেরই মন্তব্য, ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করে নিজেকে সমালোচনার পাত্র বানিয়ে এবার পুনরায় সভাপতি পদে দলীয় সমর্থনটি তার পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছেন অ্যাড. সাজু। এ থেকেই স্পষ্ট হয়েছে যে, দলীয় সিনিয়র নেতার নির্দেশেই তখন ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সাজু। আর নিজেকে বিতর্কিত করার বিনিময়ে তাকে দেওয়া হয়েছে দলীয় সমর্থন।
বিষয়টি নিয়ে হচ্ছে বিতর্কের ছড়াছড়ি। একদিকে বহুল সমালোচিত কর্মকান্ডের হোতা, অপরদিকে আ’লীগ থেকে বহিস্কার হয়েও আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সেই দলেরই সমর্থন পাওয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। যে কারণে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওবায়েদউল্লাহ সাজু।
সূত্রের তথ্যানুযায়ী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃতির কথিত অভিযোগে তৎকালীন আগৈলঝাড়ার ইউএনও তারিক সালমনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সাজু। দল থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হলেও আগামী ৮ ফেব্রুয়ারী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সভাপতি পদে অ্যাডভোকেট সাজুকে সমর্থন দেয়ায় আদালত পাড়ায় বইছে সমালোচনার ঝড়। বিতর্কিত ব্যক্তিকে সমর্থন দেয়ায় আওয়ামী লীগ ও সমমনা আইনজীবীদের বড় একটি অংশের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে । আর এ সিদ্ধান্ত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের পথ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। এবার আইনজীবী সমিতির নির্বাচন কোনো প্যানেল কিংবা ব্যানারে না হলেও তাদের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল কাজে লাগিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ের আশা করছেন বিএনপিপন্থিরা।
জেলা বিএনপির নেতা ও আইনজীবী সমিতির বর্তমান সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাচ্চু জানান, অ্যাডভোকেট ওবায়েদউল্লাহ সাজু গত এক বছর ধরে আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এসময় তিনি আইনজীবীদের স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করেননি। তবে একটি মামলা করে তার (ওবায়েদউল্লাহ সাজু) নিজ দলের মধ্যেই তিনি সমালোচিত হন।
আসন্ন নির্বাচনে ওবায়েদউল্লাহ সাজুকে সভাপতি প্রার্থী করায় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সমর্থিত প্রার্থীর জয়ের পথ অনেকটাই সহজ হয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবী সমিতির বর্তমান সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বাচ্চু ।
অ্যাডভোকেট ওবায়েদউল্লাহ সাজু জানান, গত এক বছরে আইনজীবী সমিতির অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে। কিছু কাজ এখনও অসমাপ্ত রয়েছে। অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার প্রয়োজন। তাই আসন্ন নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ তাকে সমর্থন দেয়ায় কৃতজ্ঞতা জানান।
সমালোচনার বিষয়ে অ্যাডভোকেট ওবায়েদউল্লাহ সাজু বলেন, ৫ জনের ৫ রকমের মত থাকতেই পারে। তবে ভোটে এসব প্রভাব পরবে না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সর্মথন দেয়ায় এবার বিপুল ভোটে বিজয়ের আশা করছেন সাজু।
জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন কাবুল জানান, ওবায়েদউল্লাহ সাজু গত এক বছরে আইনজীবী সমিতির অনেক উন্নয়ন করেছে। এসব কারণে আইনজীবীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সব কিছু বিবেচনা করেই অ্যাডভোকেট সাজুকে সমর্থন দিয়েছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ।
উল্লেখ্য, এক শিশুর আঁকা ছবিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবমাননা করার অভিযোগে বরিশালের আগৈলঝাড়ার তৎকালীন ইউএনও তারিক সালমনের বিরুদ্ধে গত ৭ জুন মামলা করেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদউল্লাহ সাজু। ওই মামলায় গত ১৯ জুলাই বরিশাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন গাজী তারিক সালমন। মামলায় ইউএনও তারিক সালমানকে প্রথমে কারাগারে পাঠান তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আলী হোসাইন।
২ ঘণ্টা পর বিচারক ফের তাকে জামিনের আদেশ দিলে ১০ হাজার টাকা বেলবন্ডে আদালতের হাজতখানা থেকে মুক্তি পান তিনি। এ ঘটনা গণমাধ্যমে এলে দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ইউএনও গাজী তারিক সালমনকে হাজতবাসের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের অভ্যন্তরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান খোদ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক পর্যায়ে গত ২১ জুলাই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলীয় বৈঠকে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। যে আদেশ এখন পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়নি।