আ’ লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ব্যাপক রদবদলের আভাস

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুরনো রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। এ উপলক্ষে সার্বিক প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছে দলটি। সম্মেলন ঘিরে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং ধানমণ্ডির দলের কার্যালয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর। সেখানে ভিড় করা নেতাকর্মীদের মধ্যে ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে আওয়ামী লীগের পরবর্তী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে কারা আসছেন আর কারা বাদ পড়ছেন।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদলের আভাস পাওয়া গেছে। ২০ ও ২১ ডিসেম্বর দলটির ২১তম জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে এ রদবদল আসবে। বাদ পড়বেন অনেক ‘প্রভাবশালী ও হেভিওয়েট’ নেতা, যার সংখ্যা দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের মোট সংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি।

আওয়ামী লীগের প্রায় সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের সম্মেলন শেষ হয়েছে। সম্মেলনেরই দিন প্রতিটি সংগঠনের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলো থেকে বাদ পড়েছেন বিতর্কিত নেতারা। যুবলীগ থেকে বাদ পড়েছেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে বাদ পড়েছেন ক্যাসিনোকাণ্ডের সুবিধাভোগী মোল্লা কাওছার ও প্রভাবশালী নেতা পঙ্কজ দেবনাথ। শ্রমিক লীগ এবং কৃষক লীগেও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতৃত্ব আনা হয়েছে। এবার মূল সংগঠনেও বিতর্কিত কাউকে না রাখার পক্ষে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলের ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী সংসদে এবার ব্যাপক রদবদল আনা হবে। কালিমালিপ্তদের বাদ দিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নেতৃত্বে আনা হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে যারা নিজেকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের অনেককে বাদ দেয়া হবে, আবার কাউকে কাউকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হবে।

‘নতুন মুখ, নতুন নেতৃত্বের’ যে প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড করছে, এর প্রতিফলন ঘটবে এতে। এ লক্ষ্যে দলের নবীন-প্রবীণ নেতাদের আমলনামা বিশ্লেষণ চলছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, পরিবর্তন আসবে। এ পরিবর্তনে দল থেকে কেউ বাদ যায় না, দায়িত্বের পরিবর্তন হয় মাত্র। চলমান শুদ্ধি অভিযানের প্রভাবও পড়বে কাউন্সিলে। যারা ইতিমধ্যে বিতর্কিত, তারা কমিটিতে স্থান পাবে না। নতুন-পুরনো মিলেই কমিটি হবে।

তিনি বলেন, প্রেসিডিয়াম থেকে কেউ উপদেষ্টাও হতে পারেন। আবার উপদেষ্টা থেকে প্রেসিডিয়াম, যুগ্ম সম্পাদক পদ থেকে সদস্য কিংবা সদস্য থেকে যুগ্ম সম্পাদকও হতে পারেন। কমিটি থেকে বাদও পড়তে পারেন অনেকে। আসতে পারে নতুন মুখ।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, দলের ৮১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী সংসদে ব্যাপক রদবদলের আভাস পাওয়া গেলেও এখনও অদ্বিতীয় বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা। তার কোনো বিকল্প নেই আওয়ামী লীগে। নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা আর ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক তিনি।

বারবার অবসরের ঘোষণা দিলেও নেতাকর্মীদের দাবির মুখে দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা। এবারও তিনিই দলের সভাপতি থাকছেন তা নিশ্চিত।

দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ সাধারণ সম্পাদক। তিন বছর ধরে এ পদে দায়িত্ব পালন করছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মাঝে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকলেও এখন তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক। আবারও তার এ পদে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে কাউন্সিল সামনে রেখে এ পদে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নামও শোনা যাচ্ছে। যদিও এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না কেউ।

তবে সাধারণ সম্পাদক পদে ৫ টি নাম আলোচনায় থাকলেও প্রথম দুটি (ওবায়দুল কাদের ও আবদুর রাজ্জাক) নাম নিয়েই বেশি জল্পনা হচ্ছে।

ড. আবদুর রাজ্জাকের নাম গত সম্মেলনের সময়ও আলোচনায় ছিল। ছাত্রজীবনে তিনি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন। দুই মেয়াদে মন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তিনি।

এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের যুগান্তরকে বলেন, আমি দ্বিতীয়বার পার্টির সাধারণ সম্পাদক থাকব কি না, তা নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তিনি বলেন, আমি নিজে প্রার্থী হব না। নেত্রী চাইলে আবার দায়িত্ব দেবেন, না চাইলে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেবেন।

প্রেসিডিয়াম সদস্য

আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে বাদের তালিকায় আছেন কমপক্ষে ১০ জন। বাদ পড়াদের মধ্যে সাবেক ২ মন্ত্রীসহ ৬ জন উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেতে পারেন। প্রেসিডিয়াম থেকে কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য পদ পেতে পারেন ২ জন। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ২ জন প্রেসিডিয়ামে আসতে পারেন বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে।

সম্পাদকমণ্ডলী

ক্যাসিনোকাণ্ড, দুর্নীতি ও নৌকা বিরোধিতার কারণে কপাল পুড়তে যাচ্ছে সম্পাদকমণ্ডলীর ৩৪ সদসের অনেকের। ইতিমধ্যে শীর্ষ কয়েক নেতা বাদ পড়ার বিষয়টি অবহিত হয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বিভিন্ন আলোচনায় বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক

সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে যুগ্ম সম্পাদক পদ ৪টি। এর মধ্যে জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও আবদুর রহমান সংসদ নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছেন। আসন্ন কাউন্সিলে যুগ্ম সম্পাদক দীপু মনি প্রেসিডিয়ামে যেতে পারেন। বাকি ৩ জনের দু’জন বাদ পড়ার ঝুঁকিতে আছেন। সৃষ্টি করা হতে পারে সহকারী যুগ্ম সম্পাদক পদ।

সাংগঠনিক সম্পাদক

এছাড়া দলে নিষ্ক্রিয়তা, কমিটি বাণিজ্য, নিজ এলাকায় দলীয় কোন্দলসহ নানা কারণে ৮ সাংগঠনিক সম্পাদকের ৫ জনই বাদ পড়তে পারেন। পরিবর্তন আসতে পারে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক, যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক, বাণিজ্য ও শিল্প সম্পাদক, শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক, মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক পদে।

কোষাধ্যক্ষ পদেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে বর্তমান কোষাধ্যক্ষ এইচএন আশিকুর রহমান কার্যনির্বাহী সদস্য কিংবা সম্পাদকমণ্ডলীর কোনো পদ পেতে পারেন।

কার্যনির্বাহী সদস্য

আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সংখ্যা ২৮। কাউন্সিলের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদে যাদের স্থান দেয়া সম্ভব হয় না তারা সদস্য পদ পেয়ে থাকেন। বর্তমান সদস্যদের অনেকেই নিজ পদ ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করা, মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দলীয় প্রভাব খাটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগের কারণে বাদ পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

সেক্ষেত্রে বিগত কয়েক কমিটি থেকে বাদ পড়া ত্যাগী ও প্রভাবশালী নেতা, দুর্দিনে দলের পাশে থাকা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করা পরিবারের সদস্য, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা স্থান পাবেন নতুন কমিটিতে। এছাড়া কার্যনির্বাহী সংসদের ২৮ সদস্যের মধ্যে ২ জন প্রেসিডিয়ামে স্থান পেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনৈ নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলরদের; যদিও কাউন্সিলররা বরাবরই এ দায়িত্ব তুলে দেন সভাপতি শেখ হাসিনার কাঁধে। তাই আগামী দিনে কারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন এবারও সেটি নির্ধারণ করবেন শেখ হাসিনাই।