আইসিজে ও মিয়ানমারের গণহত্যা নিয়ে ববির আইনের শিক্ষার্থীর অসাধারন পর্যবেক্ষণ

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago

মোঃ আজহারুল ইসলামঃ International Court of Justice (ICJ): আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচার আদালত। একে মাঝে মধ্যে World Court নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। এটি United Nation এর প্রধান বিচারিক অঙ্গ। ICJ এর কাজ হল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় কে Settle করা এবং সেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উপদেশ/পরামর্শ সহ বিভিন্ন অন্তর্বর্তী-কালীন আদেশ ও সমস্যা সমাধানের জন্য আদেশ দিয়ে থাকে। ICJ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ সালে জাতীসংঘ সনদের (Charter of the United Nations) মাধ্যমে এবং এপ্রিল ১৯৪৬ সালে কার্যক্রম শুরু করে। জাতীসংঘের সদস্য দেশগুলো ICJ এর আইন বা নির্দেশনা মানতে বাধ্য । এখানে মোট ১৫ জনকে বিচারপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয় সাধারণ সভা এবং নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ৯ বছর মেয়াদে। এছাড়া মামলার আবেদন কারী দেশ থেকে ১ জন এবং অভিযুক্ত দেশ থেকে ১ জনকে বিচারক হিসেবে নির্বাচিত করা হয় এবং ICJতে মোট ১৫+২=১৭ জন বিচারক থাকেন।

মায়ানমারের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে International Court of Justice এ। এটিই নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত। নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে আরেকটি আদালত অবস্থিত সেটি হচ্ছে International Criminal Court বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। Court of Justice এ এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। কিন্তু International Criminal Court এ যেকোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।

ICJ তে গাম্বিয়া মামলা করেছে মায়ানমারের বিরুদ্ধে। মায়ানমার এবং গাম্বিয়া দুই দেশেই জেনোসাইড কনভেনশন এর পক্ষ রাষ্ট্র। জেনোসাইড কনভেনশন ১৯৪৮, একটি গণহত্যা সম্পর্কিত কনভেনশন এবং এই কনভেনশন অনুযায়ী স্বাক্ষরকারী প্রত্যেক দেশ তার দেশের অভ্যন্তরের গণহত্যা প্রতিরোধ করবে। গাম্বিয়া সাধারণত অভিযোগ এনেছে মায়ানমার গনহত্যা করেছে বা গণহত্যা কনভেনশন ১৯৪৮ কে লংঘন করেছে। গাম্বিয়ার প্রশ্ন হল কেন মায়ানমার ব্যর্থ হচ্ছে গণহত্যা প্রতিরোধ করার জন্য যেহেতু সে জেনোসাইড কনভেনশন এর একজন স্বাক্ষরকারী দেশ বা রাষ্ট্র। গাম্বিয়া প্রতিকার চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছে যে, বিজ্ঞ আদালত যেন মায়ানমারের গণহত্যার বিষয়ে যথাযথ ভাবে তদন্ত সহ গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করা এবং ভবিষ্যতে মায়ানমার যেন পুনরায় গণহত্যা না করে এই জন্য মায়ানমারের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করার।

এই ব্যাপারে আমরা জানি যে এখন পর্যন্ত ২টি শুনানি হয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক এই আদালতে। আশার কথা হচ্ছে মায়ানমার ইচ্ছা করলে আন্তর্জাতিক এই আদালতে না গেলেও পারত কিন্তু তারা বিজ্ঞ আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে শুনানিতে অংশগ্রহণ করেছে এবং দেশটির একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। সাধারণত OIC এর সম্মেলনে গাম্বিয়া কে সমস্ত বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো মায়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য দায়িত্বসহ প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছে। মায়ানমার হয়তো এখানে ডিফেন্স (আত্মরক্ষা) করতে গিয়ে অনেক যুক্তি দেখাবে যে আইসিজে এর কোন Jurisdiction নেই আর গাম্বিয়া তো অনেক দূরের দেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। মায়ানমার আরো বলতে পারে আদালতে ডিফেন্স করার জন্য যে তারা গণহত্যা নয়, বরং তারা ওই এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে।

তবে আমার মনে হচ্ছে এটা নামমাত্র যুক্তি এর পিছনে শক্তিশালী কোন যুক্তি মায়ানমার দেখাতে পারবে না। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে মায়ানমারের কারণে বা রোহিঙ্গাদের এই গণহত্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি তাহলে বাংলাদেশ কেন আই.সি.জে তে মামলা করেনি। আসলে এর পিছনে অনেক কারণ লুকিয়ে আছে। যেমন- (১ম) কারণ হচ্ছে আই.সি.জে তে মামলা পরিচালনা করা অনেক ব্যয়বহুল বিষয়, (২য়) কারণ হচ্ছে কিছু কৌশলগত কারণে যদি বাংলাদেশ আই.সি.জে তে মামলা করতো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাহলে ১০ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পক্রিয়ায় বাধা আসার সম্ভাবনা ছিল বা সেই পক্রিয়াটি পিছিয়ে পড়ত বা মায়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানাতো। বাংলাদেশ হয়তো এই কারণগুলোর জন্যই আই.সি.জে তে মায়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেনি, আর সবচেয়ে বড় কারনটা হলো কোন দেশে জেনোসাইড/গণহত্যা যদি সংঘটিত হয় তাহলে তার বিচারের জন্য অন্য যেকোনো দেশ মামলা করতে পারে। এটি ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেশনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা আছে।

Article 9 বলা আছে: Disputes between the Contracting Parties relating to the interpretation, application or fulfilment of the present Convention, including those relating to the responsibility of a State for genocide or any of the other acts enumerated in Article 3, shall be submitted to the International Court of Justice at the request of any of the parties to the dispute.

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কেনো বাংলাদেশ পারবে না? বাংলাদেশ পারবে না কারণ হলো- ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে ৫টি দেশের আপত্তি রয়েছে। সেই ৫টি দেশের মধ্যে একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তখনই মামলাটি করতে পারবে যখন আপত্তি তুলে নিবে। ১৯৯৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনের পক্ষ হওয়ার সময় বাংলাদেশ ঘোষণা দেয় যেকোনো বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে বিরোধের সব পক্ষের সম্মতি প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ ”যেকোনো দেশ মামলা করতে পারবে” বাংলাদেশ সেই বিধানের বিপক্ষে। এজন্য বাংলাদেশ মামলা করে নি।

ইতোমধ্যে আমরা অনেকেই জানি মিয়ানমারের সেনা প্রধানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মায়ানমারের সেনা প্রধানের যুক্তরাষ্ট্রে কোন সম্পত্তি থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাজেয়াপ্ত করবে সেই হিসেবে মায়ানমার যথেষ্ট চাপের মুখে আছে । এখন আবার প্রশ্ন আসতে পারে যে, যদি আই.সি.জে তে মায়ানমার তার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করতে না পারে তাহলে যদি কোর্ট মায়ানমার কে ই বিষয়টি মীমাংসা এবং উপদেশ মূলক আদেশ দেয় বিষয়টি Settle করার জন্য বা অন্তর্বর্তীকালীন কোন আদেশ দেয়ার জন্য যে মায়ানমার যাতে এরকম গণহত্যা সংক্রান্ত আর কোন অপরাধ না করে এবং পরবর্তীতে যদি মায়ানমার সেই আদেশ না রাখে বা না শুনে তাহলে সেই পরিস্থিতি কি হবে সেটা আসলে খুবই বিবেচ্য বিষয়। যদি মায়ানমার আই.সি.জে এর আদেশ অমান্য করে তাহলে আই.সি.জে এর আদেশ চলে যাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে। তারপর এটার Execution হবে । এটা হলে মায়ানমারের উপর আসতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনীতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। আই.সি.জে এর ১৫ জন বিচারপতিসহ মায়ানমার থেকে একজন বিচারপতি এবং গাম্বিয়া থেকে একজন বিচারপতির মোট সংখ্যা হয় ১৭ জন । এই ১৭ জন বিচারপতির মধ্যে নয় জন বিচারপতি যে পক্ষ অবলম্বন করে মতামত বা রায় দিবেন সেই পক্ষেই রায় যাবে। সেটা গাম্বিয়া বা মায়ানমার যে কোন দেশই হতে পারে।

লেখক: (১) মোঃ আজহারুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, আইন অনুষদ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল ও এডমিন আইনী সমস্যা ও সমাধান গ্রুপ (Legal Issues & Solutions)

সার্বিক সহযোগিতায় : (২) মোঃ আল হামিদ শিক্ষার্থী, আইন অনুষদ এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও এডমিন আইনী সমস্যা ও সমাধান গ্রুপ (Legal Issues & Solutions)